নাটোরে বাঁশি বাজানোর বখসিসে চলে একাত্তরের মধু মাঝির সংসার!

বড়াইগ্রাম: নাম তার শাহাদৎ হোসেন মধু। অনেকেই তাকে মধু মাঝি বলে চেনেন। আবার অনেকে ডাকেন বাঁশি মামা বলে। কারণ বর্তমানে সে বাঁশি বাজিয়ে ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মধু মাঝির বয়স ৭২ এর কাছাকাছি। বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জোনাইল ইউনিয়নের ভিটাকাজীপুর গ্রামে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তার বয়স ছিলো ২৪ বছর ৬ মাস। ওই সময়ে চলনবিল অধ্যূষিত ওই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ছিলো নিজেদের নৌকা। নৌকা করেই এ গ্রাম-ও গ্রাম সহ হাট-বাজারে যাতায়াত করতে হতো ওই এলাকার মানুষদের। যুদ্ধ শুরু হলে মধু নিজের নৌকা নিয়ে মাঝি হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। চলনবিলের এ মাথা থেকে ও মাথা দীর্ঘ পানি পথে শক্ত হাতে বৈঠা বেয়ে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা-নেয়া করতেন। কোন কোন সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র পৌঁছে দিতেন। আর এর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা মাঝি মধুর জীবন আত্মরক্ষার্থে সার্বক্ষণিক চারটি গ্রেনেড নৌকায় রেখে দিয়েছিলেন। যা যুদ্ধ পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারই নৌকায় চড়ে যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সাত্তারের কাছে তিনি তা জমা দেন। গ্রেনেড জমা দিলে ওই সময়ে তাকে একটি কাগজও দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ১৯৭২ সালের জুন মাসে একটি প্রবল এক ঝড়ে তার ছনের তৈরী কুড়ে ঘর সহ সকল কাগজ পত্র উড়ে যায়। পরবর্তীতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেননি তিনি। অর্থকষ্টে ভুগলে তিনি চট্রগ্রাম শহরে গিয়ে সেখানে রিক্সা চালানো শুরু করেন। সেখান ১৯৭৯ সালে ৫ একর জমি, ঘর, এক জোড়া হালের গরু ও রেশন দেওয়া হবে এমন খবরের ভিত্তিতে তিনি স্ত্রী বাসিরন বেগম, দুই মেয়ে ৫ বছর বয়সী রেবা ও ৩ বছর বয়সী আলেয়াকে সাথে নিয়ে চলে যান খাগড়াছড়ি পাহাড়ী এলাকায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে বসবাস করার জন্য একখন্ড জমি পেলেও গরু বা রেশন পায়নি সে। এরপর থেকে তিনি ওখানে বাঁশি তৈরী ও তা বিক্রি করে অতি কষ্টে জীবন পার করছিলেন। সম্প্রতি একবোঝা বাঁশি কাঁধে নিয়ে তিনি এসেছেন নিজ এলাকা নাটোর জেলার বড়াইগ্রামে। ওই বাঁশি ফেরি করে বিক্রি করছেন বিভিন্ন হাট-বাজার ও গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করা এই শাহাদৎ হোসেন মধু ৪৭ বছরেরও পোলোনা কোন রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি। যারাই এই মানুষটির গল্প শোনেন তাদের সকলের মুখে এক কথা ‘মধু মাঝিকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া উচিত’। ‘রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব নেয়া উচিত’।
নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম-গুরুদাসপুর) আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বড়াইগ্রাম উপজেলা কমান্ডার মো. সামছুল হক ও গুরুদাসপুর উপজেলা কমান্ডার আনোয়ার হোসেনও তাকে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সুপারিশ পত্র প্রদান করেছেন। কিন্তু আজও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় তাকে দেয়নি কোন সনদ বা সরকারের পক্ষ থেকে পায়নি নূন্যতম কোন সুবিধা।
মঙ্গলবার সকালে মাঝি শাহাদৎ হোসেন মধুর সাথে কথা হয় উপজেলার বনপাড়া পৌর শহরের গেটে। তিনি জানান, আমি নৌকায় করে যে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছি তারা হলেন, গুরুদাসপুর উপজেলার খাগড়াদহ গ্রামের রবিউল করিম, ধারাবারিষা গ্রামের আনিছুর রহমান, মো. আজিরউদ্দিন, সাহাদত মাস্টার, আব্দুস ছাত্তার, কোনসের সেখ, বড়াইগ্রাম উপজেলার জোনাইলের মান্নান, শরিফপুর গ্রামের ইসাহাক আলী, খলিল সেখ, মৌখাড়া গ্রামের মোজাম্মেল হক, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশের সিরাজ সেখ, সোরাব আলী, মির্জা লতিফ, আনিসুর রহমান, পাবনা চাটমোহরের নুরুজ্জামান এবং মনে পড়ছে না এমন আরও ৪/৫ জন।
মধু মাঝি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের পাক-হানাদারবাহিনী বা রাজাকারদের হাত থেকে রক্ষা করতে সারা রাত ধরে নৌকা নিয়ে মাঝ নদীতে অনেক রাত কাটিয়েছি। অনেক যুবতী বউ সহ গ্রামের মা-বোনদের বিভিন্ন গ্রামের আতœীয়ের বাড়িতে পোঁছে দিয়েছি। পাক বাহিনী ও রাজাকারদের আস্তানা সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়েছি। সরাসরি যুদ্ধ করি নাই এ কথা সত্যি কিন্তু যুদ্ধে জেতার জন্য জীবন বাজী রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছি। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে রাখতে পাক-বাহিনী ও রাজাকারদের অনেক মিথ্যা কথা বলেছি। ভোরে সূর্য্য উঠার সাথে সাথে চুলো জ্বালিয়ে তাতে চাল ও গম ভাজতাম। আর সে গুলো কাপড়ে বেঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়ে যেতাম।
মাঝি মধূ কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমার দুই মেয়ে। তাদের একজন নাতি-নাতনি ও স্বামী নিয়ে খাগড়াছড়িতে বাস করছেন আর অন্য একজন স্বামী পরিত্যক্তা বর্তমানে আমার সাথেই বাস করছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বাঁশি আর ক’জন কিনেন। মূলত আমি বাঁশি বাজালে দুই-চারজন খুশি হয়ে বখশিস দেয়। আর এ দিয়েই আমার এবং আমার সাথে থাকা স্ত্রী ও মেয়ের ভরণ-পোষণ করতে হয়। ‘এক রকম ভিক্ষাই করছি আমি’ বলেই চোখের পানি ফেললেন অভাগা বয়োজেষ্ঠ মধু মাঝি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *