নাটোরের ‘ঔষধি’ ইউনিয়নে ‘এলোভেরা’ বিপ্লব

নাইমুর রহমান, লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন ঘুরে
নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নে রয়েছে ১৬টি গ্রাম। গ্রামগুলোর প্রতিটির নিজস্ব নাম থাকলেও সারাদেশে পরিচিতি অন্য নামে। কৃষিবৈচিত্র্যে ভরপুর নাটোর জেলার বিস্তীর্ণ ক্ষেতজুড়ে যেখানে কোনো না কোনো খাদ্যশস্যের আবাদ, সেখানে ব্যতিক্রম শুধু এই ইউনিয়নের গ্রামগুলো। এসব গ্রামে চাষ হয় একশ’ জাতের ভেষজ উদ্ভিদ। ভেষজ গাছের নামেই এখন দেশব্যপী পরিচিতি গ্রামগুলোর। এখানে পরিমাণে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত ভেষজ উদ্ভিদের নাম এলোভেরা বা ঘৃতকাঞ্চন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত এলোভেরা বিক্রি হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

নাটোর শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ১৬টি গ্রামের ১২টিতে আংশিক ও ৪টি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হয় এলোভেরা। তবে শুরুটা সহজ ছিলো না। ১৯৯৫ সালে আফাজ উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি প্রথম এই গ্রামে এলোভেরা গাছের চারা এনে রোপণ করেন। চার মাস পর এলোভেরার পাতা গজানো শুরু হলে তিনি বাজারে বিক্রি শুরু করেন। শহর থেকে তখন শরবত বিক্রেতারা এলোভেরার পাতা কিনে নিয়ে যেতেন। বিষয়টি লক্ষ্য করেন ওই এলাকার কয়েকজন মাদকসেবী। আফাজের দেখাদেখি তারা প্রথমে স্বল্প পরিসরে শুরু করেন এলোভেরা চাষ। পাতা গজালে তারাও বিক্রি শুরু করেন। এভাবে এলোভেরা বিক্রির টাকা দিয়ে তারা নেশা করতেন। অল্প অল্প করে কৃষি জমিতে এলোভেরার আবাদ হতে হতে দ্রুত বর্ধনশীল এই গাছের চারা রোপন শুরু করেন অন্যরাও। এভাবেই গ্রামটিতে শুরু হয় এলোভেরার চাষ।
এলোভেরা চাষে সফলতার পর গ্রামবাসীরা একের পর এক বিভিন্ন জাতের ঔষধী গাছ লাগাতে শুরু করলে এখানে ঘটে ভেষজ বিপ্লব, নাম হয়ে যায় ঔষধি ইউনিয়ন।

এলোভেরা চাষীরা জানান, একটি এলোভেরা চারাগাছের দাম ৩০ টাকা। এক বিঘা জমিতে ১২ হাজার গাছ লাগানো যায়। বিঘাপ্রতি ৫০ কেজি করে টিএসপি ও পটাশ সার প্রয়োগ করে এলোভেরার জমি প্রস্তত করতে হয়। জমিতে চারা রোপণের তিন মাস পর থেকেই তোলা যায় এলোভেরা পাতা। প্রতি সপ্তাহে একবার করে মাসে ৪ বার একটি গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা যায়। ৩টি এলোভেরা পাতার ওজন ১ কেজি। চাহিদা বেশি হওয়ায় গ্রীষ্মকালে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা এবং বছরের অন্য সময়ে ১০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয় এলোভেরা।

এলোভেরা ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রতিদিন ৩০ টন এলোভেরা ঢাকায় যায় এখান থেকে। এছাড়া বছরের অন্য সময় প্রতিদিন এলোভেরার চাহিদা থাকে ১২ থেকে ১৫ টন।

এলোভেরা চাষী রফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর তিনি ১ একর জমিতে এলোভেরার চাষ করেছেন। তবে পানিঅসহিষ্ণু হওয়ায় সেপ্টেম্বর মাসে অকালবর্ষণে নষ্ট হয়েছে ক্ষেত।

অরেক চাষী শাসমুজ্জামান জানান, নিজস্ব দুই বিঘা জমিতে তিনি এলোভেরার আবাদ করেছেন এবং প্রতি সপ্তাহে সাড়ে ৩শ’ কেজি এলোভেরা ঢাকায় বিক্রি করেন তিনি।

বনলতা ভেষজ ভান্ডারের সত্বাধিকারী কবির আহমেদ জানান, তিনি নিজের ৩ বিঘা জমিতে এলোভেরার চাষ করেছেন। সপ্তাহান্তে এলোভেরা তুলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও গাজীপুরের টঙ্গীর পাইকারদের নিকট তিনি বিক্রি করেন।

ভেষজ ঔষধ ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেন জানান, গ্রামে উ’পাদিত এলোভেরায় তৈরী ভেষজ ঔষধ তিনি ডায়াবেটিস, কোষ্টকাঠিন্যসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন।

খোলাবাড়িয়া ঔষধি গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বলেন, ভেষজ উদ্ভিদের চাষাবাদ আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা আরো বিস্তৃত চাষাবাদের সুযোগ চাই। কৃষিমন্ত্রী গ্রামগুলো পরিদর্শন করে আমাদের জন্য একটি বাজারের ব্যবস্থা করে দিলে নায্যদাম পেতে পারি আমরা।

খৃিষ্টপূর্ব যুগ থেকেই ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্রে এলোভেরার ব্যবহার পাওয়া যায়। পাতার রস যকৃত ও শাঁস ফোঁড়ায় জন্য উপকারী। হাঁপানি ও এলার্জি প্রতিরোধে ঘৃতকুমারী বৈজ্ঞানিকভাবেই কার্যকরী।

ভেষজ গবেষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উজ্জল হক জাগোনাটোর২৪ডটকমকে বলেন, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের চিকিৎসা সেবায় ভেষজ উদ্ভিদ সাশ্রয়ী ও উপযুক্ত হতে পারে। পাশ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত ভেষজ চিকিৎসার কাঁচামাল উৎপাদনে সহায়ক হওয়ায় আগামি দিনে লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন থেকেই উন্মোচন হবে বিজ্ঞাননির্ভর প্রাকৃতিক ঔষুধ উৎপাদনের নতুন দিগন্ত।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *