চামড়া কিনে বিপাকে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা

নাটোর অফিস ॥
নাটোরের চামড়া আড়তে ঈদুল আজহার দিন থেকেই চামড়া আসতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার পশু কোরবানীর পর থেকেই মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে নাটোরের চকবৈদ্যনাথ মোকামে আনেন। গত দু’দিনে বিপুল পরিমান চামড়া জেলা সদর সহ অন্যান্য উপজেলা ও পাশ্ববর্তী জেলা থেকেও গরু-ছাগলের চামড়া এসেছে। চামড়া ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন আড়তে চামড়া মজুদ করে তা লবন দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রেখেছেন। তবে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা । যারা দেরীতে আনছেন অথচ প্রক্রিয়াজাত করেননি সেসব চামড়া নাটোর মোকামে কিনছেন না কেউ। এবার লবণের দাম বেশী হওয়ায় মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অনেকেই চামড়া পক্রিয়াজাত না করেই মোকামে কাঁচা চামড়া এনে বিপাকে পড়ছেন। কোরবানির একদিন দেরীতে আনা চামড়া ফিরিয়ে দিচ্ছেন আড়দাররা। ছাগলের চামড়া নিতে অনিহা দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এবার লবণের দাম বেশী হওয়ায় চামড়া পক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশী হচ্ছে।
জয়নাল নামে মৌসুমি ব্যবসায়ী রাজশাহীর তাহেরপুরের মোল্লা বাজার এলাকা থেকে খাসি ও গরুর চামড়া কিনে ঈদুল আজহার পরদিন শুক্রবার নাটোর মোকামে আসেন চামড়াগুলো বিক্রির জন্য। কিন্তু একদিন দেরী করায় কাঁচা চামড়া কিনতে রাজি হননি কোন ব্যবসায়ী। ৫’শ থেকে ৬’শ টাকায় গরুর চামড়া কিনেছেন তিনি। আর ছাগলের চামড়া কিনেছেন ৩০ টাকা গড়ে। তিনটি গরু এবং ৬টি খাসির চামড়া ফেরত নিয়ে যেতে হয় তাকে। এতে পরিবহন খরচ সহ প্রায় আড়াই হাজার টাকা গচ্চা দিতে হয় তাকে। একই এলাকার মৌসুমী ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম ১৫শ পিস বকরির কাঁচা চামড়া এনেছিলেন নাটোর মোকামে। পক্রিয়াজাত না থাকার অজুহাত দেখিয়ে কেউ কিনতে রাজি হননি। ওই ১৫শ পিস বকরির চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়েছে তাকে।

নাম প্রকাশ না করে আরো এক মৌসুমী ব্যবসায়ী জানান, তিনি পাবনার ভাঙ্গুরা থেকে গড়ে ৮শ টাকা দরে ৭টি গরুর চামড়া নিয়ে নাটোর মোকামে আসেন। আড়তে তাকে ৪শ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়েছে।
এদিকে নাটোর মোকামে খাসির চামড়া কিনতে তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেননা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ঈদুল আজহার দিন খাসির চামড়া কিনে অনেকেই গুদামজাত করেছেন। কিন্তু পরদিন থেকে আর কিনতে চাচ্ছেননা। কয়েকজন মৌসুমী ব্যবসায়ী কোরবানীর দিন রাত ২টার পর রাজশাহীর বাঘমাড়া এলাকা থেকে প্রায় আড়াই হাজার খাসির চামড়া আনেন এই মোকামে। লবণ না দেয়ার কারনে চামড়াগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়দের কেউ কেউ বলেন, পরে চামড়াগুলো গড় মুল্য ১০ টাকা করে নিয়ে গুদামজাত করা হয়েছে। বিষয়টি গোপনই থেকে গেছে। অবশ্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের অনেকেই যেখান থেকে চামড়া কিনছেন সেখানেই লবণ দিয়ে মজুত করছেন। দুই একদিনের মধ্যে সেসব চামড়া আড়তে নিয়ে আসবেন।
ব্যবসায়ী আব্দুল হালিম শিকদার ও আমজাদ হোসেন বলেন, তারা গরু ও খাসি সহ সব ধরনের চামড়া কিনছেন। তবে খাসির চামড়া কিনে লাভবান হতে পারবেননা। একটি খাসির চামড়া লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে দুই কেজি লবণ ও মজুরি দিয়ে প্রতিটি চামড়ায় খরচ হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এতে প্রতিটি ছাগলের চামড়ায় ৩০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। তারা জানান, কোরবানির দিন চামড়া কিনে গভীর রাত পর্যন্ত লবণ মাখানো হয়েছে। এই এক রাতের জন্য একজন শ্রমিককে মজুরি দিতে হয়েছে তিন হাজার টাকা। গত কোরবানির ঈদে আমরা প্রতি বস্তা লবণ কিনেছি ৯শ থেকে ৯৫০ টাকায়। কিন্তু এবার ঈদের আগে সিন্ডিকেট করে লবণের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রতি বস্তা লবণ বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১,৩৫০ টাকায়।
জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সাধারন সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, নাটোর শহরের চকবৈদ্যনাথ এলাকায় উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম চামড়ার বাজার। এখানে দেড় শতাধিক আড়তে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। বছরের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয় কোরবানির ঈদে। এবার ৬ লাখ গরু এবং ১০ লাখ বকরির চামড়া এই মোকামে বেচা কেনা হবে বলে লক্ষ্য ধরা হয়েছে। গত দুই দিনে লক্ষাধিক পশুর চামড়া এই মোকামে এসেছে। আগামি সপ্তাহ থেকে আরও চামড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে আসবে। এই মোকামে একমাস ধরে চলবে চামড়া বেচা কেনা। এই সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চামড়া আসবে এই মোকামে। তবে এবারে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীদের অনেকেই। ব্যবসায়ীরা জানান,এবার অনেকেই মোকামে চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিলেও গত দু’দিন থেকে কেউ কেউ তাদের আড়ত বন্ধ রেখেছেন। দেড় শতাধিক আড়তের মধ্যে ৫০টির মত বন্ধ রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ জানান, বন্ধ আড়তের মালিককরা জেলা সদরে বাহিরে চামড়া কিনে প্রক্রিয়াজাত করছেন। এই সপ্তাহের মধ্যে তারা প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়া আড়তে নিয়ে আসবেন। অবশ্য এদের কেউ কেউ সরাসরি ঢাকার টেনারি মালিকদের কাছে পাঠাবেন হয়ত।

প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল ইসলাম হিরু জানান,নাটোর মোকামে ইতিমধ্যে ঢাকার ট্যানারি মারিকদের প্রতিনিধিরা চামড়া কিনতে মাঠে নেমেছেন। নাটোর মোকামে সরকারের বেধে দেয়া দামে চামড়া কেনা হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বেশী দাম দিয়েও কেনা হচ্ছে। ওই সব চামড়া ইইতমধ্যে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। শুক্রবার রাতে নাটোর মোকাম থেকে প্রায় ১০ হাজার পিস খাসির চামড়া ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এখন খাসি বা বকরির চামড়া কম দামে বেচা কেনা হলেও পরবর্তী সময়ে ভালমানের খাসির চামড়া ১শ টাকা পিস দরে বিক্রি হবে। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা নিজেদের ভুল বা অজ্ঞতার কারনে ক্ষতির মুখে পড়ছেন। তারা লবন দিয়ে পক্রিয়াজাত করে মোকামে আনলে অবশ্য সেগুলো বিক্রি হতো। ভুলের কারনে সেগুলো ফেলে দিতে হচ্ছে।
ঢাকার পান্না লেদার নামে ট্যানারির প্রতিনিধি ওহিদুজ্জামান ভুট্টু জানান, গত দুই দিনে তার কোম্পাণীর নামে প্রায় ১৫শ পিস গরুর চামড়া কিনে পক্রিয়াজাতের মাধ্যমে গুদামজাত করা হয়েছে। আরও কয়েকশ’ পিস কেনার জন্য ফরিয়াদের সাথে কথা হয়েছে। দুই একদিনের মধ্যে সেগুলো চলে আসবে।
নাটোরের আড়তদাররা বলেন, ট্যানারি মালিকরা লবণযুক্ত বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৪০ টাকা। বকরির চামড়ায় লবণ দিতে খরচ পড়ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ফলে তারা বকরির চামড়া কিনছেন না। আর গরুর চামড়া সরকার নির্ধারিত দামেই কিনছেন বলে দাবি করেন তারা। চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, নাটোর জেলায় প্রতি মৌসুমে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় অন্তত ৫০০ টন লবণ, কিন্তু বকেয়া টাকার পাশাপাশি লবণের দাম বৃদ্ধি বিপাকে ফেলেছে স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীদের। একারনে এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে ধস নামার আশংকা করছেন অনেকেই। বিশেষ করে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এবারও লোকসানের মুখে পড়ার আশংকা করছেন।
এবার ৪শ থেকে ৭শ টাকা দরে চামড়া কিনে গাড়ি ভাড়া করে এনে মুলধন তুলতে পারছেন না মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। বিপাকে পড়েছেন তারা। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারি নীতিমালা তোয়াক্কা না করেই সিন্ডিকেট করে নিজেদের ইচ্ছে মতো চামড়া কিনছেন আড়তদাররা। তাদের ইচ্ছামত গরুর চামড়ার দাম দিচ্ছেন তারা। ছাগলের চামড়া কেনার আগ্রহ নেই তাদের।
যারা ভাল দাম পাচ্ছেন তারা কাঁচা চামড়া বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীরা এবার ভাল দাম পাওয়ার আশা করছেন। চকবৈদ্যনাথ আড়ত থেকে ঢাকার ট্যানারিগুলোতে প্রায় ৫০ ভাগ চামড়া সরবরাহ বা বিক্রি করা হয়। চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান , ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিগত বছরগুলোতে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা টাকা বকেয়া রয়েছে। তবে গত দু বছর ধরে এই আড়তে নগদে বেচা কেনা হওয়ায় লাভের আশা করছেন তারা। এখানকার ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করছেন সরকারের বেধে দেওয়া দামেই এখানে কেনা বেচা হবে এবং ট্যানারি মালিকরা এখানকার ব্যবসায়ীদের বকেয়া পরিশোধ করবেন। এই মোকামে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বাড়ানো হয়েছে নজরদারি ।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *