এসিডের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়!

নবীউর রহমান পিপলু,নাটোর॥
ক’দিন আগেও খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে মুক্ত বাতাস নিয়েছেন।  প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার মত একমাত্র ফাঁকা জায়গা তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাহাদুর শাহ পার্ক নামের ওই ফাঁকা জায়গাটিতে এখন শোভা পাচ্ছে বহুতল ভবন। সেখানেই গড়ে তোলা হচ্ছে সোনার দোকান। এখন বাড়ির ছাদে উঠে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সোনা  গলানো ধোঁয়ায় এলাকার বাতাস এখন  দুষিত। নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার বাসিন্দা আইনজীবি ভাস্কর বাগচীর সাথে এলাকার পরিবেশ নিয়ে কথা বলার সময় এসব কথা তিনি বলেন । এলাকার অপর বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক একই ধরনের অভিযোগ করে বলেন, এলাকায় চলাফেরা করতে সোনা গলানো এসিডের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। প্রতি দিন আমাকে লালবাজার থেকে নিচাবাজার যাতায়াত করতে হয়। আবাসিক এলাকার মধ্যে গড়ে ওঠা স্বর্ণ পট্টির মধ্য দিয়ে চলতে বড় কষ্ট হয়। এসিডে সোনা-রুপার গলানো ধোঁয়ায় হুমকির মুখে এলাকার জনস্বাস্থ্য।
নাটোর শহরের প্রান কেন্দ্র লালবাজার ও কাপুড়িয়াপট্টির আংশিক এবং  পাশের পিলখানা মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় তিনশতাধিক সোনার দোকান গড়ে উঠেছে। এই এলাকার রাস্তার দুই ধারে গড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের মধ্যে নাটোর স্বর্ণকার পট্টি নামে সুখ্যাতি রয়েছে এই  সোনার বাজারের। অভিজাত আবাসিক এলাকা পরিচিতি পেলেও সব পেশা ও শ্রেনীর কয়েক হাজার মানুষ এই এলাকায় বসবাস করেন। সম্প্রতি এই এলাকাগুলোতে নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। এসব ভবনে মানুষের বসবাসের পাশাপাশি সোনার গহনার শো-রুম সহ গহনা তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। গড়ে ওঠা প্রায় শতাধিক এসব কারখানায় গহনা তৈরির জন্য প্রতিনিয়ত গলানো হচ্ছে সোনা -রুপা।  সোনা ও রুপা গলানোর কাজে ব্যবহার করা হয় এসিড। দোকানের সামনে রাস্তার ধারে এসিড দিয়ে সোনা পোড়ানোর ফলে অসুবিধায় পড়ছেন পথচারী। এছাড়া স্বর্ণ শিল্প কারিগর নিজেরাও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন। বিষাক্ত ধোঁয়া নাকে মুখে প্রবেশ করায় শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এসিডের বিষাক্ত ধোঁয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে এলাকার জনস্বাস্থ্য। প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে সোনা গলানোর কাজ।
চৌকির পাড় এলাকার খোকন সাহা বলেন, এসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে পিলখানা ও লালবজার জয়কালী মন্দির রোড়ের রাস্তায় চলতে সমস্যা হয়। রাস্তায় এসিডের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। এসিডের ঝাঁঝে পথ চলতে খুব কষ্ট হয়। এব্যাপারে মালিক ও কারিগরদের কাছে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়না। এসিড দিয়ে সোনা-রুপা গলানোর জন্য কারখানা সরিয়ে অন্যত্র নেয়ার দাবি করেন তিনি।
রসুলের মোড় এলাকার মুক্তার হোসেন বলেন, এলকায় সোনা -রুপা গলানোর কারনে এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। এলাকার সিংহভাগ মানুষ শ্বাকষ্টে ভুগছেন। প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একজন করে মানুষ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। এছাড়া চর্মরোগ রোগ সহ  হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এবিষয়ে জেলা প্রশাসন সহ পরিবেশ অধিদপ্তরে একাধিকবার মৌখিক ও লিখিতভাবে অভিযোগ করা হয়। জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন উদ্দোগ বা প্রতিকারের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। সোনা-রুপা গলানোর কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নিলেও কিছুটা রক্ষা পেলেও পাওয়া যেতে পারে। আমরা এই এলাকার মানুষ একটু মুক্ত বাতাসে যেন প্রান খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারি সেই আবেদন রইল সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে ।
নাটোর সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ রবিউল আওয়াল বলেন, এসিডের ধোঁয়া মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়ার কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি ও চর্মরোগ হতে পারে। এমনকি হৃদরোগ সহ নানা ধরনের শারিরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রাথমিকভাবে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি হলেও র্দীঘমেয়াদী বিষাক্ত এই ধোঁয়ার  প্রভাবে মানুষের শরীরে ক্যানসারের মত জটিল রোগও হতে পারে। নাটোর শহরের জনবহুল লালবাজার এলাকার  স্বর্নপট্টির বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছে এসিডে সোনা গলানোর জন্য। হাসপাতালে আসা শ্বাসকষ্ট বা চর্মরোগীদের অধিকাংশই এই স্বর্নপট্টি এলাকার বাসিন্দা বা স্বর্ন কারিকর।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন বলেন,বহুকাল ধরে লালবাজার ও কাপুড়িয়াপট্টি সহ আশেপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে সোনার গহনা তৈরি সহ স্বর্নালংকারের দোকান। এই লালবাজার এলাকার সোনার গহনার সুখ্যতি রয়েছে ভারত সহ দেশ-বিদেশে।  এক সময় হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ এই সোনার গহনা তৈরি ও বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন। এখন ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রায় সোনার দোকানের সাথেই রয়েছে গহনা তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় গহনা তৈরির কারখানায় এসিডে সোনা গলানো হয়। এসিড ব্যবহারের বিধি নিষেধ মানছে না কেউ।  এসব কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে রয়েছে। এসব এলাকা দিয়ে চলতে গিয়ে  নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এসব কারখানার প্রতিষ্ঠিত মালিকরা তাদের প্রয়োজনে তৈরি করছেন অভিজাত অট্টালিকা। ওই সব ভবনে একদিকে চালু করা হচ্ছে সোনার দোকান সহ কারখানা। এসব ভবনের পিছন দিকে এসিডের ধোঁয়া নির্গমনের পাইপ সংযুক্ত করায় এসিডের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে গোটা এলাকায়। এছাড়া বিল্ডিং কোড না মেনে এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন নির্মান করা হচ্ছে। এতে করে আগামীতে পানি নিস্কাসন সহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে এই এলাকায়। বর্তমানে এই এলাকার মানুষ এমনিতেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। এলাকার দু’ধারে বিশাল লালদিঘী ও জয়কালী দিঘীর মত রয়েছে জলাশয়। এই জলাশয় দু’টিও এলাকার ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসিডে সোনা গলানো বন্ধ সহ কারখানা সমুহ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হলেও কোন উদ্দোগ নেয়া হয়নি। কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেনসহ এলাকাবাসীর দাবি, বিষাক্ত ধোঁয়া বের হওয়া কারখানাগুরিকে জনবহুল এলাকা থেকে সরিয়ে লোকবসতি যেখানে কম এমন স্থানে স্থানান্তর করা হোক। এ বিষয়ে তারা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
লালবাজার এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আনিসুল ইসলাম বলেন,এলাকার মানুষদের জন্য মুক্ত বাতাস গ্রহণের জন্য বাহাদুর শাহ পার্ক নামের একটি খোলা মাঠ ছিল। এখানে অনেকেই শরীর চর্চাসহ মুক্ত বাতাস গ্রহণ করতেন। ৮০’র দশকে তৎকালীন পৌর পরিষদ সেখানে মার্কেট তৈরির উদ্দোগ নেয়। এলাকাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে সেসময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ওই মার্কেট নির্মান কাজ বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন পর বর্তমান পরিষদ সেখানে বহুতল মার্কেট নিমার্ন করেছে। নির্মান কাজ শুরু করার পর আদালতে মামলা করা হয়। পরে উচ্চ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মার্কেট নির্মান  চলমান রয়েছে। প্রতিাদ বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেও প্রতিকার মেলেনি। পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা হলেও দপ্তরের কোন প্রতিনিধি এলাকায় আসেননি। উপরুন্তু এলাকায় প্রতিনিয়ত সোনার দোকানের পরিধি বেড়েই চলেছে। বাড়ছে সোনা গলানো সহ গহনা তৈরির কারখানা। এখানকার মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে জীবন অতিবাহিত করছে। আমার মা ও আমি নিজে শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছি।  এই এলাকায় কেউ সুস্থ নেই। বর্তমানে এসিডের তীব্র ঝাঁঝ ও গ্যাসে আসবাব পত্রও নষ্ট হতে শুরু করেছে। আমার বাসা সহ অনেকের বাড়ির এসি সহ অন্যান্য আসবাব পত্র নষ্ট হচ্ছে। এলাকার মানুষ প্রতিনিয়ত বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ জেলা প্রশাসনের কাছে তার আবেদন, কারাখানাগুলো অন্যত্র সরিয়ে এলাকার মানুষদের রক্ষা করুন।
নাটোর জেলা বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভবেশ চক্রবর্তী ভক্ত জানান, নাটোর জেলায় বর্তমান মালিক সমিতির সদস্য রয়েছে প্রায় তিন শতাধিক। এসব মালিকদের মধ্যে ডিলিং লাইসেন্স রয়েছে শতাধিক। যাদের ডিলিং লাইসেন্স নেই তাদেরকে সমিতির পক্ষ থেকে লাইসেন্স তৈরি ও নবায়ন করার তাগাদা দেওয়া হয়। কোন দোকান মালিক যদি লাইসেন্স না করেন অথবা নবায়ন না করেন তার দায়ভার মালিক সমিতির নয় বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভবেশ চক্রবর্তী ভক্ত আরো বলেন, এসিড ব্যবহারের কারখানাগুলো স্থানান্তরের কথা ইতিপূর্বে শুনেছিলাম। নিরাপত্তার কারণেই হয়তো স্থানান্তর করা হয়নি। প্রশাসনিকভাবে যদি কারখানাগুলো স্থানান্তর করেন এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন তাহলে স্থানান্তরে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবেনা। তবে সোনার দোকানের কাছাকাছি কারখানা থাকলে ভাল হয়।
এবিষযে জানতে বগুড়াস্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুফিয়া নাজিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কর্মস্থলে নতুন যোগদান করেছেন বলে জানিয়ে এই প্রতিবেদককে  রাজশাহীস্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে রাজশাহীস্থ কার্যালয়ে কর্মরত সিনিয়র কেমিষ্ট মিজানুর রহমান জানান,রাজশাহী অফিসের উপপরিচালক  মাহমুদা পারভিন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। তবে মিজানুর রহমান বলেন,জনগুরুত্বপুর্ন বিষয়টি উর্ধতন কতৃপক্ষকে জানিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। দুই একদিনের মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা সহ জেলা প্রশাসন ও জুয়েলারি সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে  কথা বলে কারখানা সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সহায়তা চাওয়া হবে। এছাড়া এনিয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া যায়  সে ব্যাপারে স্থানীয় বিশিষ্টজনদেরও পরার্মশ নেওয়া হবে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, তিনি কিছুদিন হল নাটোর কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। অনেক কিছুই তিনি এখনও অবগত হতে পারেননি।  তবে আবাসিক এলাকায় এসিডে সোনা গলানোর বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের এবিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সমস্যার সমাধানে এলকাবাসী সহ বিশিষ্টজনদের সাথে আলাপ করে সমন্বিত উদ্দোগ নেয়া যেতে পারে। এবিষয়ে স্বর্ন ব্যবসায়ী সহ জুয়েলারি মালিক সমিতিকে অগ্রনী ভুমিকা পালন করতে হবে। তাদের সার্বিক সহযোগীতার প্রয়োজন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *