নাটোর পৌরসভায় অপ্রতুল বরাদ্দে স্থবির উন্নয়ন।

নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান॥ নাটোর পৌরসভার বয়স দেড়শ’ বছর। প্রথম শ্রেণির এ পৌরসভা এখন আর্থিক দৈনদশায় ধুঁকছে। ড্রেনেজ,পানি নিষ্কাশন, রাস্তা তৈরী ও সংস্কারসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ থমকে আছে অর্থের অভাবে। গত দুই বছরে পৌরসভার আয়ের প্রধান উৎস্য পৌরকর আদায়ে অর্জিত হয়নি লক্ষ্যমাত্রা। উন্নয়ন কাজের জন্য ভরসা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড ও সুনির্দিষ্ট বিশেষ তহবিল হলেও চাহিদার অনুকূলে এ তিনটি তহবিলের বরাদ্দ নিত্যান্তই অপ্রতুল। অপরদিকে রাজস্ব আয় দ্বারা পৌরসভার পরিচলন ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। তার উপর বিষফোঁড়া হয়ে আছে সাবেক মেয়রের আমলে বিভিন্ন বকেয়া পরিশোধের দায়। এছাড়াও রয়েছে কর্মকর্তা কর্মচারীদের পিআরএল, এলপিআর, গ্র্যাচুইটি বাবদ বিপুল অর্থ বকেয়া। সব মিলিয়ে দেড়শ’ বছরের অধিক সময়ের প্রাচীন এ পৌরসভায় থেমে গেছে উন্নয়ন কাজের চাকা। পৌরবাসী প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছে কাঙ্খিত নাগরিক সেবা থেকে। তবে মেয়রের দাবী, সীমিত তহবিল থেকেই উন্নয়ন কাজসহ নাগরিক সেবা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে তার পরিষদ।
ভুক্তভোগী পৌরবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, চলতি বর্ষা মৌসুমে পৌর এলাকার জলাবদ্ধতা ও খানাখন্দে পরিপূর্ণ রাস্তাঘাটই ভোগান্তির মূল কারণ। অপরদিকে, কাউন্সিলররা জানান, প্রায় প্রতিদিনই নিজ এলাকার এসব সমস্যা সমাধানে পৌরসভায়, এমনকি মেয়র ও কাউন্সিলরদের বাসাবাড়িতে ধর্ণা দিচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজ না করার জন্য দুষছেন পৌর পরিষদকে। তাদের এসব সমস্যার বিপরীতে বরাদ্দ অপ্রতুল জানালে তিরস্কারের শিকার হচ্ছেন তারা (মেয়র-কাউন্সিলররা)। প্রতিনিয়তই তাদের এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।
বিগত দুইটি অর্থবছরে পৌরসভার রাজস্ব আয় এবং এডিবি ও জলবায়ু ট্রাস্টের বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পৌরসভার রাজস্ব আয়ের প্রায় সমপরিমাণ অর্থই পরিচলন ব্যায়। দুই অর্থবছরেই এমনটি হয়েছে। অপরদিকে, পৌরসভা গত দুই বছরে পেয়েছে এডিবি ও জলবায়ু ট্রাস্টের মোট বরাদ্দের মাত্র ৫%।
পৌরসভার সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে ১লা মার্চ থেকে চলতি বছরের ৩০ শে জুন পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিবি) তহবিল থেকে মোট বরাদ্দ ছিলো দুই কোটি ৫৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এই বরাদ্দের মধ্যে দুই বছরে ছাড় হয়েছে মাত্র ৩৮ লাখ টাকা। আর জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে বরাদ্দ হওয়া দুই কোটি টাকার মধ্যে দুই বছরে ছাড় হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। এর বাইরে রয়েছে বেঁধে দেয়া বিশেষ বরাদ্দ ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টাকা। অপরদিকে, ২০১৬-২০১৭ এবং ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রাজস্ব ব্যয়ের পরিমাণ যথাক্রমে চার কোটি ২৬ লাখ ৮ হাজার ৭২২ টাকা এবং চার কোটি ৭৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৯২ টাকা, যার সমপরিমাণই দুই বছরের রাজস্ব আয়। রাজস্ব আয় থেকে পরিচলন ব্যায় নির্বাহের পর কিছুই থাকছে না, যা উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হবে। আবার বিগত অর্থবছরে দুই কোটি ৮৫ লাখ টাকা পৌরকর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আদায় হয়েছে এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অথচ মোটামুটি নাগরিক সেবা নিশ্চিতে প্রয়োজন প্রায় শতকোটি টাকা যার মধ্যে ড্রেন নির্মাণ, রাস্তা মেরামত ও আনুষাঙ্গিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই প্রয়োজন ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা। উপরন্ত বিগত দুই অর্থবছরে পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ বিল প্রদান করা হয়েছে বকেয়াসহ এক কোটি ২০ লাখ টাকা, ড্রেন ও রাস্তা পরিস্কার ও মেরামত বাবদ শ্রমিকের সম্মানী ভাতা বৃদ্ধি ও বকেয়া ভাতা প্রদান বাবদ ৩০ লাখ টাকা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি, লামগ্রান্ড বাবদ চলতি অর্থবছরে ৩০ লাখ টাকা এবং তাদের পিআরএল ও এলপিআর বাবদ বকেয়া রয়েছে ৬০ লাখ টাকা। পৌরসভার আয় অর্জন সাপেক্ষে এসব বকেয়া অর্থ পরিশোধে হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট হিসাব বিভাগ।
এমন আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে সম্প্রতি প্রতিটি ১৪ কোটি টাকা করে নাটোর পৌরসভার দুইটি প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে ২৮ কোটি টাকা। তবে কয়েকটি ধাপে এ টাকা আদায় করতে হবে পৌরসভাকে। প্রথম ধাপে বরাদ্দ ছাড় হবে মাত্র দেড় কোটি টাকা। এই দেড় কোটি টাকা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের উন্নয়ন কাজে ব্যয় করতে হবে। ৯ জন সাধারণ ও ৩ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলরের প্রত্যকে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাবেন ওয়ার্ডের উন্নয়নে। অথচ চলতি মৌসুমে প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য কাউন্সিলরদের ন্যুনতম চাহিদা এক কোটি টাকা। কাউন্সিলরদের মতে, চাহিদানুয়ায়ী বরাদ্দ পেলেও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে অনেক কাজ। কোটি টাকার চাহিদার বিপরীতে সাড়ে ১২ লাখ টাকার বরাদ্দকে ‘বানরের পিঠা ভাগাভাগি’ বলছেন তারা।
পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘শুধু চলতি বর্ষা মৌসুমেই ড্রেন নির্মাণ, রাস্তা মেরামত ও আনুষাঙ্গিক সংস্কারের জন্য আমার ওয়ার্ডে প্রয়োজন প্রায় ১ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান পরিস্থিতে প্রাপ্তব্য বরাদ্দে একটি প্রকল্পের কাজও ঠিকমত করা সম্ভব না। এমন অবস্থায় সংরক্ষিত কাউন্সিলরের সাথে ভাগাভাগি করে আপাতত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। উন্নয়ন কাজে গতি আনতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের দরকার।’
পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুর রহমান চিনু বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের জন্য ৯ লাখ টাকার একটি ড্রেন নির্মাণ প্রকল্প দেয়া আছে। তবে কাজ করার জন্য বরাদ্দ নাই এখনও। বরাদ্দ না পেলে কাজ করা যাবে না।’
পৌরসভার সংরক্ষিত ৪,৫ ও ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কোহিনূর বেগম পান্না বলেন, ‘তিনটি ওয়ার্ডে রাস্তা হলেও পানি নিষ্কাশনের ড্রেন হয়নি। ৪ নং ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা প্রধান সমস্যা হওয়ায় ভোগান্তিও বেশি। এলাকাবাসী বুঝতে চায় না পৌরসভার আর্থিক সীমাবদ্ধতা।’
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি বলেন, ‘ প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাবে কাজ করা যাচ্ছে না। পৌরবাসীর ভোগান্তি আমাকেও কষ্ট দেয়। সীমিত বরাদ্দেই যতটুকু পারা যায়, কাজের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা করছি।’ অর্থ বরাদ্দ পেলেই পৌরবাসীর আর ভোগান্তি থাকবে না বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *