নাটোরের নূর মোহাম্মদ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জীবন্ত সাক্ষী

নূর মোহাম্মদের সাথে আলাপচারিতায় জাগোনাটোর২৪ ডটকমের সম্পাদক নাইমুর রহমান

নাইমুর রহমান,বাগাতিপাড়া ঘুরে
প্রতিদিন দুপুরের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে বিহারকোল বাজারে আসেন তিনি। চায়ের দোকানে বসে রং চা পান করেন। পত্রিকা পড়েন, গল্পগুজব করেন এবং শেষ বিকেলে বাড়ি ফিরে যান। যেন এক টগবগে যুবক!

বলছিলাম নূর মোহাম্মদের কথা। তবে তিনি এখন আর যুবক নন। জন্ম তাঁর ১৯০৪ সালে।

নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের গালিমপুর গ্রামে জন্ম ও বসবাস ১১৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক নূর মোহাম্মদের। নিজ গ্রামে তিনি এক বিস্ময় মানব। এই বয়সে তাঁর স্বাভাবিক চলাফেরা ও শ্রবণশক্তি দেখে স্তম্ভিত হবে অচেনা যে কেউ।

১৯০৪ সালে বাগাতিপাড়ার গালিমপুরে নাসির উদ্দিন সরকার ও জমিরুন নেসার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন নূর মোহাম্মদ। তার স্ত্রীর নাম জোবেদা বেগম। তিনি ১৯৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে নূর মোহাম্মদের ৭ ছেলে ও ২ মেয়ে। তারা সকলেই জীবিত আছেন। বড় ছেলে এনামুর রহমানের বয়স ৯০ বছর। তিনিও শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শেষ করেছেন। আর সর্বকণিষ্ঠ সন্তান জেবুন্নেসা পারভীন। তার বয়স ৪৫ বছর। তিনি ঢাকায় কাজী ফার্মসে চাকুরী করেন।

তবে ১১৫ বছর বয়সী এ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে আর দশজনের মতই চাকুরীর স্বার্থে কমাতে হয়েছে বয়স। পাকিস্তান শাসনামলে কয়েকবারে তাকে বিভিন্ন চাকুরীতে সুযোগের জন্য বয়স কমিয়ে এফিডেফিড করতে হয়। জাতীয় পরিচয়পত্রে দেয়া তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে তার বয়স ৯৩ বছর। তবে চাকুরীর আগে ও পরে মিলিয়ে তিনি শিক্ষকতা করেছেন ৭০ বছর। চাকুরী করেছেন গালিমপুর পাইলট স্কুল ও গালিমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১০ টাকা বেতনে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি চাকুরী থেকে অবসর নেন।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করা এক জীবন্ত কিংবদন্তি এই নূর মোহাম্মদ।

সম্প্রতি জাগোনাটোর২৪ ডটকমের সাথে আলাপকালে তার ১১৫ বছরের জীবনের বেশ কিছু ঘটনা জানান তিনি।

নূর মোহাম্মদ জানান, তিনি ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের চেয়ে বয়সে মাত্র ৯ বছরের ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে ৪ বছরের ছোট। মাস্টারদা সূর্যসেন ১৮৯৪ সালে, কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালে ও তিনি ১৯০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জন্য মাস্টারদা সূর্যসেনের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন তিনি।

নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘১৯৩১ কিংবা ১৯৩২ সালে(সঠিক মনে করতে না পারায়)আমি চট্রগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়ায় যাই আমার এক ছাত্রের বিয়ে দিতে। জানতাম না ওই এলাকায় খুকু নামে আমার আরেক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছিল। সেসময় অনেক কম বয়সে বিয়ের প্রচলন ছিল। খুকুর শ্বশুর ছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের খুবই কাছের। আমি নোয়াপাড়ায় গিয়েছি জেনে খুকু এসে আমায় তাদের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং কয়েক প্রকারের বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করায়। ওর শ্বসুরের সাথে আমি নোয়াপাড়ায় মাস্টারদা সূর্যসেনের বাড়িতে যাই। তবে মাস্টারদার সাথে দেখা হয়নি। তিনি অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর থেকে পলাতক ছিলেন।’

যুবক বয়সে(১৯৩৫ থেকে ১৯৪০সাল) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সামনাসামনি দেখেছিলেন নূর মোহাম্মদ। তার চোখে এখনও ভাসে সেই মুহূর্ত।

তাঁর বর্ণনায়, ‘যাচ্ছিলাম সান্তাহার। বাগাতিপাড়ার মালঞ্চি স্টেশন থেকে উঠেছি ট্রেনে। প্রথম শ্রেণির বগিতে উঠে একটি কম্পার্টমেন্টের দরজা সরিয়ে দেখি ভেতরে একাই বসে আছেন উনি (কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। লম্বা চওড়া ড্রেস (আলখাল্লা) পড়ে তিনি বসে আছেন সিটে। মন নিবিষ্ট হাতের বইয়ে। পড়ছিলেন গীতা। এতোটাই মনোযোগ ছিল যে তিনি চেয়েও দেখলেন না কে তার দরজায়।’

এতো জনপ্রিয় একজন লেখককে সামনে থেকে দেখে তার ভেতরে কেমন অনুভূতি কাজ করছিল, জানতে চাইলে নূর মোহাম্মদ জানালেন, আমি কাঁপছিলাম এবং ভয়ে কথা বলতে পারিনি।

১৯২৭ সালের দিকে লজিং টিচার হিসেবে দিনাজপুরে বাবার পরিচিত তবার উদ্দীন নামের এক মুসলিম এক জমিদারবাড়িতে থাকতেন নূর মোহাম্মদ। ওই জমিদারের ছিল ১৭ পুত্রকন্যা। শিক্ষিত ও সুদর্শন হওয়ায় জমিদার তার এক কন্যার সাথে নূর মোহাম্মদের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে নূর মোহাম্মদরা অবস্থাসম্পন্ন না হওয়ায় রাজি হননি।তবে বছরদুয়েক পরে তিনি বিয়ে করেন।

দিনাজপুরের ওই জমিদারবাড়িতে এসেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও লোকসঙ্গীত সম্রাট আব্বাস উদ্দীন। এই দুই সঙ্গীতপ্রেমী ব্যক্তিকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় একটি এ্যাসোসিয়ন চাঁদা তুলে দিনাজপুরে এনেছিলেন কবি নজরুল ও সঙ্গীতজ্ঞ আব্বাস উদ্দীনকে। উপর্যুক্ত জায়গা না থাকায় আসর বসানো হয় জমিদারবাড়িতেই। নজরুল ও আব্বাস উদ্দীন তিনটি গান গেয়েছিলেন সেদিন। ব্যস্ততা থাকায় গান শেষে তারা দ্রুত চলে যান বলে কথা বলার সুযোগ পাইনি, তবে দেখেছি একেবারে সামনে থেকে।’

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষীও নাটোরের শতবর্ষী এ ব্যক্তি। তিনি স্মৃতিচারণ করেন, ‘যুদ্ধের সময় নাটোরে আসতাম রেলনাইনের নীচ দিয়ে। তখন ডবল লাইন ছিলো। এক লাইন দিয়ে সবসময়ই আমেরিকান সৈন্যদের রসদবাহী রেল চলাচল করত। এখানে (বাগাতিপাড়ায়) আমার বাবা-নানার জমিতে সৈন্যরা ট্যাংক পুঁতেছিলো। এখানকার কয়েকজন সৈন্যদের ব্যারাকে কাজ করতো চাকর হিসেবে। তারা সৈন্যদের খাবার ও সিগারেটের ভাগ পেত। ২০ টা সিগারেট ছিলো দোআনা। চাকররা নিজেরা খাবার পর বাকী সিগারেট বেঁচে দিতো। আফিম দিয়ে তৈরী সে সিগারেট খেয়েছি আমিও। জঙ্গল সাফ করার পর সাপে কেটে অনেক সৈন্যও মরেছে এখানে।’

শিক্ষকতা কারার সময় একজন দক্ষ সংগঠকও ছিলেন নূর মোহাম্মদ। প্রতিবছর স্বরস্বতী পূজার সময় হিন্দু শিক্ষকদের পাশাপাশি তিনি নিজেও পূজার চাঁদা সংগ্রহ করতেন। তৎকালীন সময়ে নাটোর শহরের শুকুলপট্টি এলাকার তারাপদ শুকুল ও নকুল শুকুলের খুবই প্রিয় ছিলেন তিনি। তাদের কাছ থেকে পূজার খরচ বাবদ মোটা অংকের চাঁদা আদায়ের ব্যবস্থা করে দিতেন নূর মোহাম্মদ।

নিজের শৈশবের বর্ণায় নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন একজন সৌখিন মানুষ। ছোটবেলায় তিনি বাড়ির চাকরের হাতে টাকা দিয়ে বলতেন আমার ছেলেকে সার্কাস, যাত্রা দেখিয়ে আন। সেই সুবাদে আমি মনের খায়েশ মিটিয়ে অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি। ছোটবেলায় বাড়িতে একটা গরু ছিলো যা সকাল সন্ধ্যায় দুইসের করে দুধ দিতো। সেই দুধের ছানা তৈরী করে বন্ধুদের নিয়ে প্রতিদিন খেতাম। হিন্দু বন্ধুদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা ছিলো আমাদের।’

স্মার্টফোনকে বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেছেন নূর মোহাম্মদ। তিনি জানান, জীবনে তিনি এই বস্তটি ব্যবহার করেননি। কোনদিন কল্পনাও করেননি এমন কিছু আবিস্কৃত হবে।

১১৫ বছর বয়সে অনেকটাই নীরোগ নূর মোহাম্মদ। তিনি জানান, এলার্জিজনিত কারণে তার শ্বাসকষ্ট হয় মাঝে মাঝে। এছাড়া ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ নেই।

জীবন সায়াহ্নে এসে এই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, ‘অনেক ভাগ্য আমার যে প্রতিবছর ঈদে নামাজ পড়তে পারি চার জেনারশনের সঙ্গে। আমার ছাত্র, তার ছেলে, তার ছেলেকে আমি পড়াতে পড়াতে আমি রিটায়ার্ড করেছি। শেষ ছাত্রদের নাতিপুতিদের আমি দেখছি এখন।’

নূর মোহাম্মদের ছেলে রেজাউন্নবী রেনু বলেন, আমার বাবা তার সুদীর্ঘ জীবনে অনেক ঘটনার স্বাক্ষী। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসনামলে চাকুরীজনিত কারণে বাবার প্রকৃত বয়সটা সামনে আনা হয়নি। তবে তিনি এখনও সুস্থ এবং কারো সহযোগিতা ছাড়াই চলাফেরা করেন। তিনি সকলের নিকট দোয়া চান।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন বাগাতিপাড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুঞ্জুরুল আলম মাসুম বলেন, বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী নিভৃতচারী শিক্ষক নূর মোহাম্মদের ঘটনাবহুল জীবনের সেভাবে খোঁজ করিনি আমরা। তিনি তার প্রকৃত বয়স আমাদের বলতেও আসেননি কখনো। তবে আমরা গর্বিত যে এমন একজন মানুষ আমাদের এখানে রয়েছেন। নতুন প্রজন্মের জন্য বিষয়টি সৌভাগ্যই বলা চলে। তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *