১৭ তম জিআই সনদ পাওয়া নাটোরের কাঁচাগোল্লা যেত বিলেতসহ ভারত বর্ষের সর্বত্র

নাটোর অফিস ॥
কাঁচাগোল্লা। নাম শুনলেই এসে যায় নাটোরের কথা। এক সময় জমিদারদের মিষ্টিমুখ করাতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। রাজা জমিদার ও ব্রিটিশ শাসনামলে বিলেতের রাজ পরিবারে এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরও যেত ভারত বর্ষের সর্বত্র। এখন রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড কিংবা নৌ-ঘাট, সবখানেই নাটোরের নামে বিক্রি হয় কাঁচাগোল্লা। তবে শুধু নাটোরের মানুষরাই বুঝতে পারেন কাঁচাগোল্লার নামে কি বিক্রি হচ্ছে। আসল-নকল যাই হোক, দেশের প্রসিদ্ধ মিষ্টান্নগুলো সারা দেশে অন্তত একই রকম আকারে বিক্রি হতে দেখা যায়। শুধু ব্যতিক্রম নাটোরের কাঁচাগোল্লা। উপকরণে তো হয়ই, আকারেও বিকৃতি হচ্ছে নাটোরের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টান্ন। নামের সাথে থাকা ‘গোল্লা’ থাকার কারণে নাটোরের বাইরে গোলাকার চমচমের আকারে তৈরী ও বিক্রি হয় কাঁচাগোল্লা।
কাঁচা ছানা থেকে তৈরী মিষ্টান্ন কাঁচাগোল্লা গোলাকার নয়। কিন্তু চিনি মেশানো কাঁচা ছানা ছোট ছোট বলের মতো তৈরীর পর ‘নাটোরের কাঁচাগোল্লা’ নামে বিক্রি ঠেকাতে ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে এবার মিলল স্বীকৃতি। দেশের ১৭ তম জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল নাটোরের কাঁচাগোল্লা। গত ৮ আগস্ট শিল্প মন্ত্রণালয়ের ট পেটেন্ট,শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের স্বাক্ষরে নাটোর জেলা প্রশাসকের নামে কাঁচাগোল্লার জিআই স্বীকৃতি অনুমোদন দেয়া হয়।
প্রায় ২৬৩ বছর পর সুস্বাদু মিষ্টান্ন কাঁচাগোল্লার ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন নাটোরের সাবেক ও রাজাশাহীর বর্তমান জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। গত ৩০ মার্চ এফিডেভিটের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) মাধ্যমে নাটোরের কাঁচাগোল্লার জিআই আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
জানা যায়, ১৭৬০ সালের কিছু আগে তৎকালীন নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার মধুসূদন পালের মিষ্টির দোকান ছিলো এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ দোকান। দোকানের বড় বড় চুলায় মধুসূদন পাল প্রতিদিন দেড় থেকে দু’মণ ছানা দিয়ে পানতোয়া, চমচম, কালো জাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন দশ পনেরজন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনিমেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। সৃষ্টি হয় এক নতুন মিষ্টান্ন, যার নাম দেয়া হয় কাঁচাগোল্লা। ১৭৬০ সালে বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা মহারাণী ভবানী রাজত্বকালে এই কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানিতোয়া প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজ পরিবার পর্যন্ত এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরও যেত ভারত বর্ষের সর্বত্র।
ঐতিহ্যবাহী এই কাঁচাগোল্লা দীর্ঘদিন ধরে বিকৃত আকারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়ে আসছিলো। তবে এ নিয়ে নাটোরের মানুষের করণীয় কিছুই ছিলো না। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের প্রসিদ্ধ একটি খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নাটোরে তাদের ব্রান্ড শপে গোলাকার কাঁচাগোল্লা বিক্রি শুরুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এর পর থেকে নাটোরের সুধীমহল এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করে। এ অনুরোধের প্রেক্ষিতে উদ্যোগ নেয়া হল কাঁচাগোল্লার ভৌগোলিক নির্দেশক নিবন্ধনের। অবশেষে জিআই স্বীকৃতির পর এই বিকৃত উৎপাদন বন্ধ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চার পুরুষ ধরে মিষ্টি ব্যবসার সাথে জড়িত নাটোরের ঐতিহ্যবাহী জয় কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার। জিআই স্বীকৃতির ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এই দোকানের বর্তমান সত্বাধিকারি প্রভাত কুমার পাল বলেন, জিআই আবেদন অনেক আগেই করা দরকার ছিল। কেননা বিভিন্ন রকমের মানহীন মিষ্টি কাঁচাগোল্লা নামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়। এতে নাটোরের সুনাম নষ্ট হয়। এখন জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বিকৃত আকারে উৎপাদন বন্ধ হবে। দেশের মানুষ আসল কাঁচাগোল্লা চিনে কিনতে পারবে।
নাটোর পৌর মেয়র উমা চৌধুরী বলেন, কাঁচাগোল্লা জিআই তালিকাভুক্তি হল। এর মধ্য দিয়ে নাটোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশ বিদেশে কাঁচাগোল্লার ব্র্যান্ডিং ও চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এ সংক্রান্ত যে কোন উদ্যোগে পৌর কর্তৃপক্ষ পাশে থাকবে।
নাটোরের সাবেক জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, নাটোরের কাঁচাগোল্লার ইতিহাস সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে বিদায়ের পূর্বক্ষণে জিআই নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। অবশেষে জিআই স্বীকৃতি এলো।নাটোরের এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের স্বীকৃতি আদায়ে ভুমিকা রাখায় আনন্দিত বোধ করছি।
নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুঞাঁ বলেন, নাটোরের ঐতিহ্য ধরে রেখে উৎপাদকরা কাঁচাগোল্লা প্রস্তুত করেন। কিন্তু বাইরে বিকৃত আকারে কাঁচাগোল্লা বিক্রি হয় বলে বিভিন্ন সময় শোনা যায়।জেলা প্রশাসন এর বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখবে।প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এই বিকৃতি রোধ করা হবে।
নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি কাঁচাগোল্লার স্রষ্টা মধুসূদন পাল আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি কাঁচাগোল্লা রয়ে গেছে সবার মাঝে। অমৃতের স্বাদ আর সুনামের পাশাপাশি ঐতিহ্য বহন করছে যুগযুগ ধরে। কাঁচাগোল্লার কদর শুধু দেশই নয়, রয়েছে বিদেশের মাটিতেও। শুধু তাই নয়, অর্ধ বঙ্গেশ্বরী খ্যাত নাটোরের রাণী ভবানীর প্রিয় খাদ্যের তালিকায় ছিল এই মিষ্টি। এখন সেই কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্য হিসাবে তালিকাভুক্ত হলো। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট,ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) ৮ আগোস্ট এক সভায় এ অনুমোদন দেয়।এতে খুশি নাটোর বাসী সহ মিষ্টি ব্যাবসায়ীরা। এ খবর প্রচার হবার সাথে সাথে নাটোরর মধুসূদন পালের বংশধরদের মিষ্টর দোকানে সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *