আত্নীয় নন, আপনি আমাদেরই

নাটোরের মাটিতে তিনি যেদিন প্রথম পা রাখেন তখন রেওয়াজ অনুযায়ী পরিচিতি পরবর্তী বৈঠক করেছিলেন। যাইনি সে বৈঠকে। কারণ তখন একটি বিশেষ সময় বিশেষ দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলাম। জানলাম, যিনি এসেছেন তার নাম সাইফুল্লাহ আল মামুন। উনি সাহিত্য জগতের লোক। ধরাবাধা রুটিন দায়িত্বের পাশাপাশি লেখেন। জানার পর সিদ্ধান্ত নিই দেখা করার। কিন্ত সুযোগ হয় না আর।

সামনাসামনি আলাপ হল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। মুখোমুখি বসে তার কথাবার্তা ও আচরণেই বুঝতে পারলাম তিনি যতটা না একজন জেলা পুলিশের শীর্ষকর্তা, তার চেয়েও বেশি একজন লেখক, একজন গবেষক, একজন অসম্ভব খোলা মনের মানুষ। তাকে সবই বলা যায় মন খুলে। অথচ তিনি এমনই একজন মানুষ, যাকে না খুঁজলে তার সম্পর্কে জানা যাবেই না।

নাটোর ছাড়ার মাসখানেক আগে তার কিছুটা পরিচয় খুঁজে পেলাম। কিছুটা না বলে যৎসামান্য বলাই ভালো। তার অন্যতম একটি পরিচয় তিনি একজন স্থপতি যার কর্মনৈপূণ্যে এখন পুলিশ সুপারের কার্যালয় মানেই স্থায়ী সাজ সাজ রব। শুধু তাই নয়, বদলে দিয়েছেন পুলিশ লাইন্সও।

সাইফুল্লাহ আল মামুন কিন্ত নাটোর পুলিশে একজন সংস্কারক হয়ে স্মরণীয় হয়ে রইলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে যখন দেশব্যপী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার পরপরই গত ২১শে নভেম্বর তিনি নাটোরের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করলেন। তখন তার সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়ালো জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কোনপ্রকার রক্তপাত ও সহিংসতা ছাড়াই শেষ হল নির্বাচন। এটি নির্দ্বিধায় তার নেতৃত্বের ফলাফল যা আমাদের মেনে নিতে হবে।

এসব ছাপিয়ে তিনি সবচেয়ে সফল মাদক বিরোধী আন্দোলনে। আমরা সংবাদকর্মীরা এর সাক্ষী। তিনি মাদকের বিরুদ্ধে নাটোরবাসীর অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি করলেন এবং সফল হলেন। পাড়ায় মহল্লায় সাইনবোর্ড উঠল, ‘অপকর্ম রোধে অপকর্মের ব্যবহার, মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি হবে গণ শৌচাগার’। শহরের বড়গাছা এলাকায় এই শ্লোগানের প্রতিফলন ঘটলো। মাদক এখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না এলেও অবশ্যই দুষ্প্রাপ্য হলো।

পদ-পদবী,পদোন্নতির আশায় বহু সরকারী কর্মকর্তাকে দেখেছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুধু জপই করতে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম-মৃত্যুর বাদে আর কোন বিষয়ে তাদের আগ্রহ দেখিনি। ব্যতিক্রম দেখলাম, সাইফুল্লাহ আল মামুন রীতিমত লেখেন এবং গবেষণা করেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। অথচ এর প্রচার নেই। নিজ কার্যালয়ে সাইফুল্লাহ আল মামুনের নিজস্ব সৃষ্টি বাণীপ্রধান ‘সাইবিতা’ দেয়ালে স্থান করেছেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম এ প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একজন উদ্যমী, হার না মানা ব্যক্তিত্বের উদাহরণ। তাঁর চেহারাটা চোখের সামনে ভাসলেও সাহস পাই। প্রশ্ন করেছিলাম, পুলিশের অনেক বড়কর্তাই নিজ প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্ণার তৈরীর মাধ্যমে দৃষ্টিগোচর হয়েছেন। এক্ষেত্রে আপনার কোন প্রচারণা নেই কেন? উত্তরে বলেছিলেন, ‘প্রতিটি মানুষই ভিন্নভাবে জাতির পিতাকে স্মরণ করবে। তাকে সে অধিকার দিতে হবে। মূল বিষয়টি হল স্মরণ আর চেতনায় লালন’। এমন উত্তরের পরে আর প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না।

দেশেও এবার পুলিশ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নতুন ধারা সংযোজন করলেন সাইফুল্লাহ আল মামুন। আমরা গর্বিত কারণ স্বচ্ছতার শুরু নাটোর থেকেই হল। কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করেই সাড়া ফেলে দিলেন তিনি। ধরা পড়ল উত্তারাঞ্চলজুড়ে নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত বিশাল এক প্রতারক চক্র। এত বড় একটা সাফল্যের পরও সমালোচনা তার পিছু ছাড়েনি। হঠাৎ করে নাটোরে বেড়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন হত্যাকান্ডের ঘটনা বাড়তে থাকল।   বলাও হল, পুলিশ সুপার তার রুটিন ওয়ার্কের বাইরে সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকায় এমনটা ঘটছে। এসব সমালোচনার জবাব হিসেবে উত্তরাঞ্চলের   মোটরসাইকেল ছিনতাই চক্রের অন্যতম হোতা শুটার মানিক গ্রেফতার হল। মানিক মানুষকে হত্যা করে মোটরসাইকেল ছিনতাই করতো। পরে মানিক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।

প্রচারবিমুখ পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন অনেকগুলো সামাজিক সংগঠনকে নিয়ে মানবতার কল্যানে কাজ করতেন। তন্মধ্যে একটি সংগঠন খোলা জানালা। অসহায় মানুষ ও পথশিশুদের নিয়ে তাদের অনেক কাজে সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন সাইফুল্লাহ আল মামুন। সম্প্রতি খোলা জানালাকে নিয়ে তিনি ‘বৃক্ষমাণিক’ নামে অনবদ্য এক মাদকবিরোধী প্রচারণায় নামেন। নাটোরে চাকরীর শেষদিনেও তিনি শতবর্ষী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সম্মানিত করেছেন। পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতে একটি মডেল জলাশয়ে দেশি মাছের পোনা অবমুক্তও করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারংবার পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সেবার মনোভাব নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি পুলিশ সদস্যদের মানুষের আস্থায় পরিণত হবার তাগিদ দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীর এই তাগিদ বাস্তবায়নে নাটোরে সচেষ্ট ছিলেন পুলিশ সুপার। শুরু থেকেই তার সেবামুখী মনোভাব ছিল সর্বমহলে প্রশংসনীয়। আর বাংলাদেশ রেলওয়ের মতো সর্ববৃহৎ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তার নেতৃত্বে আরো বেশি সমৃদ্ধ হবে তাও বলাই বাহুল্য।

বিদায়, হে মানবতার ফেরিওয়ালা। এ মাটির মানুষ আপনাকে মনে রাখবে। বিদায় এখানে শুধুই কাগজ কলমে হলো। আপনার সাথে আমাদের সম্পর্ক আত্নার। আপনি আমাদের আত্নীয় নন, আপনি আমাদেরই।

লেখকঃ
নাইমুর রহমান
সম্পাদক, জাগোনাটোর২৪. কম
বার্তা সম্পাদক, দৈনিক প্রান্তজন
ডিসট্রিক্ট করেসপনডেন্ট, দি এশিয়ান এইজ ও বার্তা২৪.কম।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *