বাড়ি ফিরে ভাত খেতে চেয়ে ফিরলেন লাশ হয়ে

নাটোর অফিস ॥
সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় পাথর বোঝাই ট্রাক ও লেগুনার সংঘর্ষে নিহত ৫ শ্রমিকের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। সড়কে স্বজন হারিয়ে চোখ অন্ধকার পাঁচ পরিবারের। উপারর্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে দিশেহারা। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে ওই ৫ জন ধান কাটা শেষে টাঙ্গাইল থেকে তাদের বাড়ি নাটোরে ফিরছিলেন একটি লেগুনাতে করে। সকালে নিহতদের বাড়িতে তাদের মৃত্যুর খবর পৌঁছিলে

গ্রাম জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। দুপুর ১২ টার দিকে মৃতদেহগুলোর মধ্যে বাগাতিপাড়া উপজেলার ছোট পাকা গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে মকুল হোসেন (৩৫), আবুল হোসেনের ছেলে মনির হোসেন (৩৪) এবং একই উপজেলার বাশবাড়িয়া গ্রামে জমির উদ্দিনের ছেলে মকবুল হোসেন (৩৫), ইজাল হকের ছেলে আব্দুল হালিমের (৩৭) লাশ আনা হয় তাদের বাড়িতে। নিহত অপরজন গুরুদাসপুর উপজেলার জুমাইগর গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে হায়দার আলীর (৪০) লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী জানান, তাদের মৃত্যুর খবর গ্রামে আসার পর থেকেই নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। গত ১০-১৫ দিন আগে ধানের জমিতে কাজ করতে টাঙ্গাইল যায়। তাদের মধ্যে ছোটপাকা গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে মকুল হোসেন, এবং আবুল হোসেনের ছেলে মনির হোসেন,বাঁশবাড়িয়া গ্রামের জমির উদ্দিনের ছেলে মকবুল হোসেন , ইজাল হকের ছেলে আব্দুল হালিম বাড়ি ফেরার পথে মারা যান। আর আহত হন একই গ্রামের লাবুর ছেলে মঞ্জু। তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

নিহতদের মধ্যে বাগাতিপাড়া উপজেলার চার জনই কৃষিশ্রমিক। তারা ধানকাটার কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। আর গুরুদাসপুরের জুমাইনগরের নিহত ব্যক্তি লিচু বিক্রি করে ফিরছিলেন বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়।
এদিকে নিহতদের লাশ তাদের বাড়িতে আনা হলে শুরু হয় বুক ফাটা আর্তনাদ। নিহত মুকুলের স্ত্রী নবজাতক সহ নাবালক তিন সন্তানকে নিয়ে স্বামীর পাশে আহাজারি করতে থাকেন। বলতে থাকেন কাজ করে টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরবেন বলেছিলেন। বাড়ির পথে রওনা হয়ে ফোনে বলেছিলেন রাতেই বাড়ি ফিরে ভাত খাবেন।

পাশের বাড়ির নিহত মনিরের স্ত্রী , বৃদ্ধা মা ও বিধবা বোনের আহাজারিতে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। প্রতিবেশীরা জানায়,মনির ছিলেন ৫ সদস্যের পরিবারের উপার্জনের একমাত্র ব্যাক্তি। মনিরের মেয়ে ৯ ম শ্রেণীর মেয়ে কেঁেদ কেদে বলছিল,এখন আমার লেখাপড়ার কি হবে। কে বা আমাদের দেখভাল করবেন। শোকাহত মনিরের স্ত্রী শোকের মাতম করছিলেন আর বলছিলেন,রাতে বাড়ির পথে রওনা হয়ে

আমাকে বলেন,ভাত রেঁধে রাখ। রাতে ফিরেই ভাত খাব। তিনি ফিরে এলেন ঠিকই,কিন্তু লাশ হয়ে ফিরলেন।
বাঁশবাড়িয়া গ্রামের নিহত মকবুলের স্ত্রী বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। জ্ঞান ফিরে পেয়েই মৃত স্বামীর লাশের কাছে ছুটে যান এবং আহাজারি করে বলতে থাকেন আমাদের এতিম করে তুমি কোথায় গেলে। প্রতিবেশী নিহত আব্দুল হালিমের বাড়িতেও চলছিল শোকের মাতম। নিহত হালিমের স্ত্রী পাগলের মত চিৎকার করছিলেন আর বলছিলেন এখন তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে আমার কি হবে।

গুরুদাসপুরের নিহত হায়দার আলীর স্ত্রী সন্তানরা তার মৃত্যুর সংবাদে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। বিলাপ করছেন আর বলছেন কি ভাবে চলবে তাদের সংসার।
এদিকে সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় নাটোরের ৫ শ্রমিকের নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার পর পরই জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ নিহতদের বাড়িতে ছুটে যান এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। এসময় তিনি নিহতদের পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রত্যেক পরিবারকে দাফনের জন্য নগদ ৫ হাজার করে টাকা প্রদান করেন এবং প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষনা দেন। নিহতদের পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য সার্বিক সহযোগীতা করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং গ্রামবাসীদের নিহত পরিবারগুলোর পাশে থেকে সহযোগীতার করার অনুরোধ করেন। এসময় বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা দেবী পাল,উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম গকুল,স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *