নাটোর অফিস।।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নাটোরের পথে পন্তরে ছুটে বেড়িছেন ও সংবাদ লিখেছেন দৈনিক সমকাল ও একুশে টেলিভিশনে। আর কখনো খবর লিখবেন না তিনি। নাটোরের বর্ষিয়ান সাংবাদিক দৈনিক সমকাল ও একুশে টেলিভিশনের নাটোর প্রতিনিধি রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলুর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
বুধবার (০৭ মে) নাটোর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে বর্ষিয়ান এ সাংবাদিকের মরদেহের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল ৯টায় সেখানে তার শেষ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নামাজে জানাজা শেষে সকাল সাড়ে ৯ টায় গাড়ীখানা নাটোর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আখতার জাহান সাথী তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এ সময় বেজে ওঠে বিউগলের করুণ সুর। এর আগে জাতীয় পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয় নবীউর রহমান পিপলুর মরদেহ। এরপর মুক্তিযোদ্ধসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ সময় সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক কাজী গোলাম মোর্শেদ, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহŸায়ক জিল্লুর রহমান খান বাবুল চেীধুরী, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান আসাদস, সমকাল উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি লিমন বাসার, রাজশাহী বুরো প্রধান সৌরভ হাবিব, একুশে টিভির রাজশাহী বিভাগীয় প্রতিনিধি বদরুল হাসান লিটন, নাটোরের তিনটি প্রেসক্লাবের সাংবাদিক সহ বিভিন্ন উপজেলার সাংবাদিকবৃন্দ বক্তব্য দেন। এসময় সমকাল লালপুর প্রতিনিধি আশিকুর রহমান, সিংড়া প্রতিনিধি আব্দুর রশিদ, গুরুদাসপুর প্রতিনিধি নাজমুল হোসেনসহ সমকাল সংবাদিক বীরমুক্তিযোদ্ধা পিপলুর বন্ধুসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মী সহ অসংখ্য মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহন করেন এবং শ্রদ্ধানিবেদন করেন।
এসময় বক্তারা বলেন, ‘সমকালেরর নাটোরের বর্ষিয়ান সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলুর মৃত্যুতে নাটোর একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিককে হারাল।’ এ সময় তারা মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
নবীউর রহমান পিপলু প্রায় চার দশকের বেশি সময়জুড়ে নিরলস শ্রম, কঠোর অভিনিবেশ, অসামান্য পেশাদারিত্বের মধ্যদিয়ে নাটোরের সাংবাদিকতা করেছেন। দীর্ঘসময় সাংবাদিকের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক এই ব্যক্তিত্ব স্বীয় কর্ম ও কীর্তির ধারাবাহিকতায় ওপার থেকে আলো বিতরণ করে যাবেন বলে নাটোরের বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশনে কর্মরত সব সহকর্মী মনে করেন।
নবীউর রহমান পিপলুর মৃত্যুতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাড. এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুতে সমকাল পরিবারের পক্ষ থেকে সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী গভীর শোক প্রকাশ ও শোকসন্তপ্ত পরিবারে প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
নাটোরের সকল সাংবাদিকরা তার মৃত্যু সংবাদে গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়েন। অনেকেই ছুটে আসেন তার বাড়িতে। নাটোরের বিভিন্ন পত্রিকার সব বয়সী সাংবাদিকের শোকস্তব্ধ মুখ আর কান্নাভেজা চোখ জানিয়ে দিচ্ছিল- তাদের মাথার ওপর থেকে বিরাট এক ভালোবাসার ছায়া বটবৃক্ষ ছেড়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছে। জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ের সব প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক সবাই তাদের প্রিয় ‘পিপলু ভাই’য়ের অনন্তযাত্রায় শোকস্তব্ধ, আবেগবিহ্বল।
৬৯ বছর বয়সী নবীউর রহমান পিপলু মৃত্যুকালে স্ত্রীসহ অগণিত গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তবে তার কোনো সন্তান ছিল না। নবীউর রহমান পিপলু ১৯৫৭ সালের ১০ জানুয়ারি বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার চাকুরির সুবাদে তিনি সপরিবারে নাটোরে আসেন। তিনি নাটোরের আলাইপুর এলাকার বাসিন্দা এবং তৎকালীন নাটোর হাসপাতালের কর্মচারী রশিদুর রহমান ও নূরুননেছা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। নববীউর হমান পিপলুর ১১ ভাই বোনের মধ্যে ৯জন জীবীত রয়েছেন। তিন ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান।
১৯৮১ সালে দৈনিক জনতা পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে ২০০৫ সালে সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের হাত ধরে সমকালে সাংবাদিকতা করেন। মৃত্যু পর্যন্ত সমকালে সাংবাদিকতা করেছেন। এছাড়াও একুশে টেলিভিশনের শুর থেকে নাটোর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তার সাংবাদিকতা জীবনে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস তুলে ধরতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
নাটোরের সিনিয়র সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নবীউর রহমান পিপলু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। তিনি শুধু একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাই নন, বরং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা ও সমাজসেবার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন বীউর রহমান পিপলু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নাটোরের ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের ছাত্রাবাসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে তিনি ভারতের বালুরঘাট, রায়গঞ্জ ও শিলিগুড়ির বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলা ও অ্যাডভান্স প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। তিনি ৭ নম্বর সেক্টরের তুফানি ব্যাটালিয়নের সদস্য হিসেবে হিলি, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, গোবিন্দগঞ্জ ও নওগাঁ এলাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একটি উল্লেখযোগ্য অভিযানে তিনি নওগাঁ সীমান্তের ফার্সিপাড়া সেতু ধ্বংস করতে গিয়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং সফলভাবে শত্রæদের পিছু হটাতে সক্ষম হন।
উল্লেখ্য, পিপলু দীর্ঘদিন থেকে বোন ম্যারু রোগে এ আক্রান্ত ছিলেন। পরে গত ৪ মে সন্ধ্যায় ঢাকার বাড্ডায় এ এম জেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ৬৯ বছর বয়সী এই সাংবাদিককে মঙ্গলবার ৬মে সকালে হাসপাতালের আইসিউকে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল সাড়ে ১০ টার সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।