বর্ষীয়ান সাংবাদিক সমকালের নাটোর প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু আর নেই

নাটোর অফিস।।
নাটোরের বর্ষীয়ান সাংবাদিক দৈনিক সমকালের নাটোর প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার নবীউর রহমান পিপলু ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মঙ্গলবার (০৬ মে) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার এএমজেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ব্লাড ক্যান্সার ও বোনম্যারো রোগে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। মৃত্যুকালে স্ত্রী, আতœীয় স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তবে তার কোনো সন্তান ছিল না।
নবীউর রহমান পিপলু ১৯৫৭ সালের ১০ জানুয়ারি বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার চাকুরির সুবাদে তিনি সপরিবারে নাটোরে আসেন। তিনি নাটোরের আলাইপুর এলাকার বাসিন্দা এবং তৎকালীন নাটোর হাসপাতালের কর্মচারী রশিদুর রহমান ও নূরুননেছা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। নববীউর হমান পিপলুর ১১ ভাই বোনের মধ্যে ৯জন জীবীত রয়েছেন। তিন ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান।
১৯৮১ সালে দৈনিক জনতা পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে একুশে টেলিভিশন ও দৈনিক সমকালের শুরু থেকে নাটোর প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রয়াত নবীউর রহমানের ভাগনির স্বামী সামিউল ইসলাম সামি জানান, মামা আজ সকাল ১০টায় বেসরকারি একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। বোনম্যারো সংক্রান্ত জটিলতা ছিল তার। বাড়িতে তার স্ত্রী রয়েছেন। তার কোনো সন্তান নেই। আমরাই ছিলাম তার সন্তানের মতো।
সামি আরো জানান, আজই তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নাটোরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগামীকাল সকাল ৯টায় গার্ড অব অনার শেষে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে।
নাটোরের সিনিয়র সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নবীউর রহমান পিপলু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। তিনি শুধু একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাই নন, বরং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা ও সমাজসেবার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। নবীউর রহমান পিপলুর মৃত্যুতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাড. এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুতে সমকাল পরিবারের পক্ষ থেকে সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী গভীর শোক প্রকাশ ও শোকসন্তপ্ত পরিবারে প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। এছাড়াও  সাংবাদিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন বীউর রহমান পিপলু। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নাটোরের ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের ছাত্রাবাসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে তিনি ভারতের বালুরঘাট, রায়গঞ্জ ও শিলিগুড়ির বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলা ও অ্যাডভান্স প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। তিনি ৭ নম্বর সেক্টরের তুফানি ব্যাটালিয়নের সদস্য হিসেবে হিলি, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, গোবিন্দগঞ্জ ও নওগাঁ এলাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একটি উল্লেখযোগ্য অভিযানে তিনি নওগাঁ সীমান্তের ফার্সিপাড়া সেতু ধ্বংস করতে গিয়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং সফলভাবে শত্রæদের পিছু হটাতে সক্ষম হন।
সাংবাদিকতা ও সমাজসেবা
মুক্তিযুদ্ধের পর নবীউর রহমান পিপলু সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশন ও দৈনিক সমকালের নাটোর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি নাটোর ইউনাইটেড প্রেসক্লাবের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সাংবাদিকতা জীবনে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস তুলে ধরতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
পারিবারিক জীবন ও ব্যক্তিগত অনুভূতি
নবীউর রহমান পিপলুর পরিবারে ১১ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। তার আরও ৯ ভাইবোন জীবিত রয়েছেন। তার বাবা রশিদুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন, তবে দুঃখজনকভাবে তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি, যা পিপলুর জন্য গভীর বেদনার বিষয়।
নবীউর রহমান পিপলু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সহযোদ্ধা ও শহীদদের স্মৃতি বহন করেন এবং তাদের অবদানকে স্মরণ করে গেছেন।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
নবীউর রহমান পিপলু তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বিভিন্ন সময়ে সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক কমান্ডের আয়োজনে ৩৫ বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকদের মধ্যে সংবর্ধিত হন। এছাড়া, তিনি নাটোরে গঠিত সংবাদপত্র রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রমেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
রাজশাহী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাল্য বন্ধু অলক মৈত্র বলেন, পিপলু আমার বাল্য বন্ধু। ষাটের দশকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক একসাথে পড়ালেখা করেছি। একসাথে খেলাধুলা বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন করেছি দুজনে একসাথে। ১৯৭১ সালে দেশকে ভালোবেসে ভারত থেকে ট্রেনিং শেষ করে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে। অর্জন করেন মুক্তিযুদ্ধের খেতাব। এলাকায় সৎজন ব্যক্তি হিসেবে সে পরিচিত। পিপলুর এমন মৃত্যুর খবরে এলাকায় শোক বয়ে যাচ্ছে। নাটোরের মানুষ একজন সৎ আদর্শবান নিরেপেক্ষ সাহসী সাংবাদিক হারালো।
নাটোর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম রেজা বলেন, নাটোর জেলার একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ছিলেন নবীউর রহমান পিপলু। বর্ষিয়ান সাংবাদিকের মৃত্যু মেনে নিতে পারছিনা। আমার শুধু আমাদের সহকর্মী নয়, একজন সাহসী কলম যোদ্ধাকে হারালাম ।
তিনি ১৯৭১ সালে দেশকে ভালোবেসে ভারত থেকে ট্রেনিং শেষ করে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে। অর্জন করেন মুক্তিযুদ্ধের খেতাব। এলাকায় সৎজন ব্যক্তি ও সৎ নিভিক সাংবাদিক হিসেবে সে পরিচিত। তার মৃত্যুর খবরে নাটোর সাংবাদিক সমাজ থেকে শুরু করে সর্বত্র শোক বয়ে যাচ্ছে। নাটোরের মানুষ একজন সৎ আদর্শবান নিরেপেক্ষ সাহসী সাংবাদিক হারালো।
নাটোর ইউনিক প্রেসক্লাবের সভাপতি দেবাশীষ কুমার সরকার বলেন, নবীউর রহমান পিপলু ছিলেন নাটোরের একমাত্র বীরমুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীন সাংবাদকি। তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বত্র। তিরি জীবনের ঝুঁকি তিনি শত শত সংবাদ প্রকাশ করেছেন। তিনি এত তারাতারি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন আমরা ভাবতে পারি নি। তার শূণ্যতা অপূরনীয়। একজন নবীউর রহমান পিপলু আর কখনোই তৈরি হবে না।
নাটোর ইউনাইটেড প্রেসক্লাবের সভাপতি নামিস উদ্দিন নাসিম বলেন, সদা হাসোজ্জল নাটোরের বর্ষীয়ান সাংবাদিক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু ভাই। তিনি ছিলেন আমাদের গুরুজন। তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছিনা। তিনি কাউকে ভয়ও পেতেন না, তাই জীবনের ঝুঁকি তিনি শত শত সংবাদ প্রকাশ করতে পেরেছেন। তার মৃত্যু নাটোরের সাংবাদিক জগতে এক বিরাট শূণ্যতা তৈরী করেছ যা কখনো পূরনীয় নয়।
আজকের পত্রিকার নাটোর প্রতিনিধি নাইমুর রহমান বলেন, একজনই বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক ছিলেন নাটোরে। আমি চার বছর তার সাথে ছায়াসঙ্গীর মতো চলেছি। নাটোরে সাধারণ মানুষকে তাকে ভালোবাসতে দেখেছি। তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল সর্বত্র। তাই জীবনের ঝুঁকি তিনি শত শত সংবাদ প্রকাশ করতে পেরেছেন। তিনি কাউকে ভয়ও পেতেন না, কাউকে সমীহ করেও চলতেন না।আমাদের সহকর্মী শুধু নয়, একজন সাহসী কলম যোদ্ধাকে হারালাম আমরা। অসুস্থ অবস্থা তিনি সংবাদ লিখে গেছেন। একজন নবীউর রহমান পিপলু আর তৈরি হবে না।
নবীউর রহমান পিপলু ছিলেন নাটোর জেলার একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক। নবীউর রহমান পিপলু আমাদের জাতির গর্ব। তার সাহস, ত্যাগ ও নিষ্ঠা আমাদের প্রেরণা জোগায়। তরুণ প্রজন্মের উচিত তার মতো বীরদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশপ্রেম ও মানবসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করা।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *