
নানাবাড়ির ঠিক পিছনেই ছোট্ট একটা আদুরে নদী। সুযোগ পেলেই গ্রামের ডানপিটে সাথীদের সঙ্গে নিয়ে, নানার কাছে কাকুতি মিনতি করে অনুমতি আদায় করে চড়ে বসতাম ছোট ডিঙি নৌকায়। তবে খুব বেশী দূর যাওয়ার সাহস হতো না,বড়জোড় পাশের পাড়ার ঘাট পর্যন্তই। শত ইচ্ছা থাকলেও নদীর ওপারের গ্রামটাতে নামা হয়নি কোনদিনই। ঐ গ্রামের পিছনেই যে বিশাল হাওড় শূন্যে মিলিয়ে গেছে ,ওটার দিকে হা-ভাতের মত তাকিয়ে থাকতাম শুধু। মনে হতো,ওখানে একবার গেলেই ,ব্যাস,আকাশটাকে পেয়ে যাব! ভাবতাম,এখন যেতে না দিক,বড় হই ,তখন কে আটকাবে!
নৌকায় বসে নদীর দু’তীরের গ্রামগুলোক মনে হত এগুলো শুধু এমনি এমনি বেড়ানোর জন্যই,ওখানে সত্যিকারে থাকতে নেই। লোকেরা মজা করে দেখবে বলেই এত আয়োজন,এই যেমন- দুষ্টু ছেলে গুলোর উদাম গায়ে নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি, খুব ব্যাস্ত বউ গুলোর হাঁটু পানিতে নেমে কাপড় চোপড় ধোয়া, গোবেচারা চেহারার মাঝ বয়েসী লোকগুলোর একমনে নৌকায় বসে মাছ ধরা,আরও কত কী! খুব ইচ্ছে হতো হুট করে ওদের দলে ভীড়ে পড়ি এমন ভাবে যেন আমিও ঠিক ওদের মতই আটপৌরে এই গ্রামীণ জীবনে। নৌকায় বসে আরও খেয়াল হতো,“আচ্ছা,এই নদীটার দূরের বাঁকে,কালচে সবুজ আর পাহাড়ের উঁচু নিচু টিলার মত দেখতে অজানা,অচেনা গ্রামগুলোতে টুপ করে চলে গেলে কেমন হয়? গ্রামের লোকগুলোকে খুব অবাক করে দিয়ে ওদের সব রহস্য,সব গল্প যেনে চলে আসতে পারতাম! হুমম,বড় হয়ে নেই,একদিন বের হবোই নৌক নিয়ে। সেদিন নদীর সবুজাভ পানির সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুরে বেড়াবো এ গ্রাম ও গ্রাম”।
এরপর,অনেক বড় হয়েছি।কত বড় বড় কাজ আর কঠিন কঠিন ব্যাপার নিয়ে সময় পার করেছি। ছোট্ট মেয়ের ভাবনা গুলো শুধু হাঁসির খোরাকই হয়েছে। এখন যখন মহা ব্যাস্ত আমি হঠাৎ থমকে গেছি প্রকৃতির অমোঘ অভিমানে,বোধ জেগেছে, কী স্বার্থপরের মতই না ভুলে গিয়েছিলাম প্রকৃতির কাছে করা আমার সরল,আদি শপথ। একবার ও খোঁজ নেইনি মেঠোপথটার,ডোবার টলটলে পানির,বুনো কলমি আর ঘাসফুলটার,ছোট্ট আদুরে নদীটার,অবুঝ শ্যামলিমার-ওরা ভালো ছিল তো?
এবার যদি বেঁচে যাই,আমার শপথ,ছুটে যাব ওদের কাছে,জানতে,”ভালো আছো তো”?
লেখক-
শরীফা চৌধুরী
প্রভাষক(ইংরেজি)
ভাষা বিভাগ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়



