নাটোরে বেশি দামে চামড়া কিনে নিঃস্ব মৌসুমী ব্যবসায়ীরা

নাটোর অফিস॥ ঈদুল আজহার দিন সকাল থেকে বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিপিস ৬০০ টাকা দরে ৩টি গরু ও ২০টাকা টাকা দরে ৬টি খাসির চামড়া কিনেছিলেন মাস্ক ব্যবসায়ী আবুল কালাম। বিকেলে শহরের চকবৈদ্যনাথ চামড়ার আড়তে গিয়ে দেখেন গরুর চামড়ার সর্বোচ্চ দাম ৩০০ টাকা আর খাসি মাত্র ১০ টাকা। মাত্র দুই হাজার টাকা পুঁজিও শেষ পর্যন্ত ফেরাতে পারেননি মৌসুমি ব্যবসায়ী আবুল কালাম। পঁচে নষ্ট হওয়ার ভয়ে ওই দামেই আড়তে বিক্রি করেন চামড়াগুলো।

নাটোর চামড়া আড়তের বিদ্যমান শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের কারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই চামড়া বেচে লাভের মুখ দেখেছিলেন না বিগত বছরগুলোতে। এবারে তুলনামূলক কম পুঁজির ব্যবসায়ীরা একেবারেই পথে বসে গেছেন। শুধু তারাই নন, দানের চামড়া বিক্রি করে প্রত্যাশিত দাম পায়নি মাদরাসাগুলোও।

পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা নাটোরের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা দুষছেন আড়তদারদের। অপরদিকে আড়তদাররা বলছেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য বারবার লোকসানের কবলে পড়েন।

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার যে দামই বেঁধে দেয় না কেনো, নিজেদের মর্জির বাইরে চামড়া কেনেন না নাটোরের আড়তদাররা। ঈদের দিন দুপুর থেকেই বাজারে চামড়া আমদানির পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করেন আড়তদারদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। চলমান করোনা পরিস্থিতর কারণে এবছর কোরবানির পরিমাণ কম হবে বলে ধারণা করা হলেও অপ্রত্যাশিতভাবে বেশি পশু কোরবানি হওয়ায় ঈদের দিন চার ঘণ্টায় প্রায় ২০ হাজার পিস গরু ও খাসির চামড়া কেনাবেচা হয়। চামড়ার আমদানি বেশি দেখে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট খাসি ও গরুর চামড়ার দাম অর্ধেকে নামিয়ে আনে। লবণজাত না করায় অনেকে পচনের ভয়ে চামড়া বিক্রিতে বাধ্য হয়।

অপরদিকে ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া ক্রয় অব্যাহত রেখেছেন। শিল্প মন্ত্রণালয় নির্ধারিত চামড়ার মূল্য সম্পর্কে কোনো ধারণা না নিয়ে শুধু প্রতিযোগিতার জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীরা একে অপরকে টেক্কা দিয়ে বেশি দামে বাড়ি বাড়ি থেকে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। বাজারমূল্য সম্পর্কে অবহিত না হয়ে চামড়া কিনে বিক্রির সময় লাভের মুখ না দেখাটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এ আড়তের ব্যবসায়ীরা ঈদের আগে বকেয়া পাওনার সামান্য কিছু আদায় করতে পারায় পুঁজি সংকটেও ভুগেছে। এতে ঈদের দিন অনেক আড়তদার প্রয়োজনীয় পরিমাণ চামড়া কিনতে পারেনি।

সদরের জংলী এলাকার আব্দুস সবুর বলেন, ঈদের দিন ৩০ পিস গরু ও ৪৫ পিস খাসির চামড়া কিনেছিলাম। বিক্রির সময় চামড়াপ্রতি ২০০ টাকা লোকসান হয়েছে। খাসির চামড়া বিক্রি করতে না পেরে নদীতে ফেলে দিয়েছি।

চামড়া ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান বলেন, প্রতিপিস ২০ টাকা দরে আড়াই হাজার পিস খাসির চামড়া কিনেছিলাম। লবণজাত করতে চামড়াপ্রতি আরও ১০ টাকা খরচ হবে। সেই চামড়া বিক্রির জন্য আড়তে পাঠালে ১০ টাকা দাম বলে। বাধ্য হয়েই লবণজাত না করে মাটিতে পুঁতে ফেলেছি।

গুরুদাসপুর কাছিকাটা এলাকার ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন বলেন, চামড়া কেনা দামের অর্ধেকেও বিক্রির অবস্থা নেই। লবণজাত করে রেখে দিয়েছি ৩০০ পিস চামড়া। ন্যূনতম দামের অপেক্ষায় আছি যাতে কেনা দাম উঠে আসে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একটি মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের তত্ত্বাবধায়ক বলেন, লিল্লাহ বোর্ডিংগুলো খুব বেশি নির্ভরশীল ছিলো ঈদে চামড়া বিক্রির উপর। দানের চামড়া বিক্রির টাকায় মাস দুয়েক মাদরাসা ছাত্রদের তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা হতো। এখন দুই সপ্তাহও হয়না। যারা চামড়ার দামে কারসাজি করলেন তারা গরীব-এতিমতের হক নষ্ট করলেন।

জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি শরিফুল ইসলাম বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অজ্ঞতার কারণে অনেক চামড়া পঁচে নষ্ট হয়েছে। তারা ঠিকমতো কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করতে পারেনি। আমরা তো নষ্ট চামড়া কিনতে পারি না। এছাড়া বাজারের অবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে চামড়া কিনলে তাদের লোকসান হতো না।

চামড়া বাজার পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমরা পর্যবেক্ষণ করছি সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে কি না। আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দামেই কেনাবেচা করছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যদি বেশি দামে চামড়া কিনে থাকেন, তবে লোকসান তাদেরই বহন করতে হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *