৭১-এ একই পরিবারের ১১ শহীদের পঞ্চাশ বছরেও খোঁজ নেয়নি কেউ

নাটোর অফিস ॥
আজ ১১ এপ্রিল। ৭১ এর এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের সময় শহীদ হয়েছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের পারকোল গ্রামে একই পরিবারের ১১ জন। এছাড়া ওই পরিবারের ২ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। কানু সরকার ও ওসমান আলী সরকার নামে গুলিবিদ্ধ সেই ২ সদস্য ক্ষত নিয়ে যন্ত্রনায় দিন কাটাচ্ছেন যুগের পরে যুগ। দীর্ঘ ৫০ বছরেও এই শহীদ পরিবার রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় তাদের শারীরীক যন্ত্রনার সাথে যুক্ত হয়েছে মানসিক যান্ত্রনা। এছাড়া ওই পরিবারের ১১ শহীদ সহ ১৭ শহীদের গণকবরও পড়ে রয়েছে অবহেলা ও অরক্ষিত অবস্থায় । এসব শহীদ ও যুদ্ধাহতদের সরকারী সুযোগ সুবিধা সহ রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতির দাবী জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সহ এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যরা।
উনিশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের মুক্তিকামী বাঙ্গালী যোদ্ধারা নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় পাকসেনাদের প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে থাকে। বড়াইগ্রাম উপজেলার ধানাইদহ এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের ওপরে ধানাইদহ ব্রিজ পাহারায় ছিলেন তৎকালীন ইপিআর,পুলিশ-আনসার সসদ্য সহ মুক্তিযোদ্ধারা। সময়কাল ১৯৭১ এর ১১ এপ্রিল। এই দিন চোখের সামনে বাবা-মা ও ভাই-বোন সহ পরিবারের ১১ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন শহীদ শুকুর আলী সরকারের ছেলে কানু সরকার। এছাড়া তিনি নিজে এবং তার চাচা ওসমান আলী সরকার গুলিবিদ্ধ হন। কানু সরকার জানান, চোখের সামনে তার বাবা শুকুর আলী সরকার, মা কাঞ্চনী বেগম, ভাই জানু সরকার, দাদী বাবুনি বেগম,বড় আব্বা ছবি সরকার,বড়মা গোলাপী বেগম,তাদের মেয়ে জালেদা খাতুন, আরেক চাচা আছের উদ্দিন সরকার,চাচী জয়েনা বেগম,চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম ও ফুপাতো ভাই মজব আলীকে প্রকাশ্যে ব্রাশ ফায়ার করে পাকসেনারা। প্রাকসেনাদের ব্রাশ ফায়ারে শহীদ হন তারা। আমি ও আমার চাচা ওসমান আলী সরকার এসময় গুলিবিদ্ধ হই। পাকসেনাদের ছোড়া গুলি এসে আমার বাম পায়ের হাঁটুতে লাগে এবং আমার পাশে থাকা চাচা ওসমান আলীর মাজায় লেগে গুলি বেড়িয়ে যায় । রক্তে সয়লাব হয়ে যায়। দু’জনায় যন্ত্রনায় ছটফট করছিলাম। তবে পাকসেনাদের নজরে যেন না পড়তে হয় সেজন্য দু’জনার কেউ কোন টু-শব্দ করিনি। একদিকে বাবা-মা সহ পরিবারের লোকদের মৃত্যু দেখে ডুকরে কাঁদতেও পারছিলামনা। তেমনি যন্ত্রনায় গোটা শরীরে কাঁপুনি শুরু হলেও সাহায্যের জন্য কাউকে চিৎকার করে ডাকতেও পারছিলামনা।এদিন পাকসেনাদের গুলিতে আমার পরিবারের ১১ জন সহ ১৭ জন শহীদ হন। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর আমরা বের হয়ে আসি। এসময় অনেকেই ছোটাছুটি করে নিরাপদ দুরত্বে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। স্থানীয়রাই আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। পরে নিহতদের আমাদের বাড়ির পাশে বাঁশ বাগানের মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। আমরা পরিবারের যেকজন জীবিত ছিলাম তারা নিরাপদ স্থানে সরে যাই। পরে স্বাধীনতার পর ওই গণকবর চিহ্নিত করে পাঁকা করা হয়।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বড়াইগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আব্দুস সাত্তার জানান, ৭১ এর ১১ এপ্রিল পাকসেনাদের একটি দল ঢাকা-নাটোর মহাসড়ক দিয়ে নাটোরের দিকে আসার পথে ধানাইদহ ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এসময় ভারি অস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনাদের একটি দল পিছু হটে প্রায় এক কিলোমিটার পথ ঘুরে পারকোল গ্রামের মধ্যে ঢুকে এলোপাতারি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। পাকসেনাদের ভারি অস্ত্রের মুখে প্রতিরোধ করা সম্ভব না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে থাকেন। এসময় ধানাইদহ ব্রিজ এলাকায় মাহাবুব আলী ও সিরাজুল ইসলাম নামে দুই আনসার সদস্য সহ অন্তত ২০ জনমুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের কয়েকজনকে ব্রিজের পাশে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর ব্রিজের পাশে গণকবর চিহ্নিত করে পাকা করা হয়েছে। বিভিন্ন দিবসে এসব শহীদদের ¤্রদ্ধা জানানো হয়। সেদিনের স্মৃতি চারন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার আরো জানান, ইপিআর,আনসার ও পুলিশ সদস্য সহ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রতিরোধে বাধা পেয়ে পাকসেনাদের একটি দল গ্রামের পথ ধরে পারকোল গ্রামে ঢুকে পরে। তারা ওই গ্রামে প্রবেশের পথে এলাপাতারি গুলিবর্ষন সহ বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এসময় প্রতিরোধের চেষ্টা করলে ওই গ্রামের ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে শুকুর আলী সরকার সহ তার পরিবারের নারী-পুরুষ মিলে ১১ জন শহীদ হন। গুলি বিদ্ধ হন শুকুর আলী সরকারের ছেলে কানু সরকার ও তার চাচাতো ওসমান আলী সরকার।এসময় শহীদদের রক্তে লাল হয়ে যায় ওই গ্রামের একটি পুকুর।
পারকোল গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম জানান, পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর আত্মগোপনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারন মানুষ নিহতদের লাশ গ্রামের একটি বাঁশ বাগানের মধ্যে গণকবর দেয়। স্বাধীনতার পর স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুদানে গণকবর পাকা করে চিহ্নিত করে এলাকাবাসী। এরপর গত ৫০ বছরেও আর এই গণকবর ও শহীদদের খোঁজ নেয়নি কেউ। গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ শুকুর সরকারের ছেলে কানু সরকার ও তার পরিবারের অপর সদস্য ওসমান আলী সরকার প্রায় পঙ্গুত্ব জীবন কাটাচ্ছেন। শহীদ পরিবারগুলো পায়নি সরকারী সাহায্য সহ রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি। গুলিবিদ্ধরা এখনও পায়নি কোন সহায়তা। তাঁদের খোঁজও নেয়না কেউ। বিশেষ দিনগুলোতেও এই শহীদদের স্মরনও করা হয়না। গণকবর পড়ে রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। এসব শহীদ ও যুদ্ধাহত পরিবারকে রাষ্ট্রিয়ভাবে রাষ্ট্রিয়ভাবে তালিকা করা সহ সরকারী সহায়তার দাবী জানিয়েছেন শহীদ পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
বড়াইগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শামছুল হক জানান, ১১ শহীদের ওই পরিবারকে শহীদ পরিবারের মর্যাদা দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে আবেদন করা হয়। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। এখন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে আবেদন করতে পারেন তাদের পরিবার থেকে। তবে ওই ১১ শহীদ সহ ১৭ জনের গণকবরটি অরক্ষিত অবস্থায় থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন।
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, একই পরিবারের ১১ জন শহীদ হয়েছেন এমন খবর তিনি জানার পর তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। দীর্ঘ দিনেও তাদের কেউ খোঁজ নেননি এমন খবর তাকে পিড়া দিয়েছে। তিনি তাদের পাশে রয়েছেন। তাদের জন্য যে ধরনের সহায়তার প্রয়োজন তা তিনি করবেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *