অনিমা জুয়েলার্স’এর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ

নাটোর অফিস॥
নাটোরের তৈরি স্বর্ণালংকারের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। বাংলাদেশ ছাড়াও এখানকার স্বর্ণালংকারের সুনাম ছড়িয়ে রয়েছে উপমহাদেশের অনেক দেশে। রাজা জমিদারের শাসনামলে গড়ে ওঠা এই স্বর্ণপট্টি নাটোর পৌরসভা দুই নম্বর ওয়ার্ডের পিলখানা, লালবাজারের আংশিক ও কাপুড়িয়া পট্টি এলাকার আংশিক জুড়ে রয়েছে। এখানকার স্বর্নালংকার ভাল ও দামী সোনার হওয়ায় এর কদর রয়েছে । সুনামের পাশাপাশি গ্রাহকদের ঠকানো সহ প্রতারনার অভিযোগও রয়েছে। সম্প্রতি নাটোর স্বর্ণকার পট্টির সবচেয়ে বড় স্বর্ণের দোকান অনিমা জুয়েলার্স‘এর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। নাটোর শহরতলি হাফরাস্তা তালতলা এলাকার ডাঃ আব্দুল হাই নামে এক গ্রাহক এই দোকান মালিকের মাধ্যমে প্রতারনার শিকার হয়েছেন। তবে দোকান মালিকের দাবি কোনো রকম প্রতারণা করা হচ্ছে না। আর পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা বলছেন প্রতারক যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
বার্ধক্যজনিত কারনে নিজ বাড়িতে শয্যাশায়ী ডাঃ আব্দুল হাই জানান, অনেক কষ্টে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ২০০৯ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর অনিমা জুয়েলার্স থেকে একজোড়া স্বর্নের বালা তৈরির অর্ডার দিয়েছিলাম। যে অলংকারটি আমাকে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছিল একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর। ২ ভরি ওজনের স্বর্ণের বালার দাম মজুরিসহ ধরা হয়েছিল ৪৬ হাজার ৮ শত ২০ টাকা। সমুদয় টাকা পরিশোধ করে বালাটি সরবরাহ করেন দোকান মালিক। যে অলংকারের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা। সম্প্রতি অসুস্থ থাকার কারণে আমার স্ত্রী জোৎ¯œা বেগম স্বর্ণের দোকান অনিমা জুয়েলার্সে গিয়ে মেমো দেখিয়ে অলংকারটি বিক্রি করতে যান। দোকান মালিক নিরেন্দ্রনাথ কর্মকার দুলাল মোমোটি দেখে বলেন, মেমো আমাদের দোকানের, তবে স্বর্ণ অলংকারটি আমাদের দোকানের না এবং অলংকারটি র্স্বণের নয়। দোকান মালিকের এমন কথা শুনে বিক্রেতার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অনুনয় বিননয় করেও দোকান মালিকের মন গলাতে পারেননি। এসময় দোকান মালিক ওই মহিলার সাথে রূঢ় ব্যবহার করলে মহিলা মনের কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। জোৎ¯œা বেগম নামে ওই বৃদ্ধ মহিলা জানান, তিনি তার চোখে ভাল দেখতে পাননা। তাই ডাক্তারের পরামর্শে চোখ অপারেশন করার জন্য গহনা বিক্রি করতে এসে প্রতারনার শিকার হন। শুধু এই গ্রাহকই প্রতারনার শিকার হননি। অনেকেই অনিমা জুয়েলার্সে সোনার গহনা বানিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম হাগুড়িয়া গ্রামের লুৎফা বেগম জানান, ‘অনিমা জুয়েলার্স থেকে একটি সোনার চেইন তৈরি করিয়েছিলাম। প্রায় ১৫ দিন ব্যবহার করার পর সোনার রং তামাটে হয়ে যায়। বিষয়টি জানাতে দোকানে গেলে দোকানদার বলেন,আপনার শরীরে এলার্জি আছে, তাই কালার ডিসকালার হয়ে গেছে। তবে সমস্যা নেই ঠিক করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষতক ওই চেইন সোনার গহনা নয় জানার পর ফেলে দিতে হয়েছে। অনিমা জুয়েলার্সের মালিকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেশ কয়েকদিন দোকানে গিয়েছেন। কিন্ত ঠিক করে দেওয়া দুরে থাক পরবর্তীতে আর কথায় বলেননি দোকান মালিক। তাদের আচরনে সন্দেহ হওয়ায় অন্য স্বর্নের দোকানে ওই গহনা দেখালে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। ওই দোকানি জানান,আমার সেই গহণা সোনার নয়। এরপর অনিমা জুয়েলাস মালিকের মালিকের সাথে এনিয়ে একাধিকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে। কোন কিছুই তিনি কর্নপাত করেননি। ফলে বাধ্য হয়েই ফিরে আসি। গ্রাহকদের অনেকের অভিযোগ ,অনিমা জুয়েলার্সে কোন গহনা তৈরির পর প্রয়োজন হলে তা বিক্রি করতে গেলে অর্ধেক সোনা পাওয়া যায়না। অভিযোগ করলে তারা কর্নপাত করেননা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আশেপাশের বেশকয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী জানান, ‘মাঝেমধ্যেই অনিমা জুয়েলার্সের ভিতরে খরিদ্দারদের হট্টগোলের শব্দ শোনা যায়। অনিমা জুয়েলার্স দোকান মালিকের বিরুদ্ধে অনেক ক্রেতাই প্রতারণার অভিযোগ করেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বিত্তবান হওয়ায় তার বিরুদ্ধে এলাকার কেউ কথা বলেন না। নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার সমসপাড়াা গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের নীরেন্দ্র নাথ কর্মকার দুলাল স্বর্ণ ব্যবসা করে এখন শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
অনিমা জুয়েলার্সের প্রতারনার বিষয়টি জানার পর এই প্রতিবেদক সহ কয়েকজন স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী সোমবার বিকেলে শহরের লালবাজার এলাকায় অনিমা জুয়েলার্সে গিয়ে দোকান মালিক নীরেন্দ্র নাথ কর্মকার দুলালের কাছে প্রতারনার অভিযোগের বিষয়টি জানতে চান। এসময় নীরেন্দ্র নাথ কর্মকার দুলাল ওই গ্রাহকের কাছে থাকা মেমো তার দোকানের এবং স্বর্ণের বালার দাম মজুরিসহ ৪৬ হাজার ৮ শত ২০ টাকা গ্রাহকের কাছে থেকে নিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। তবে সোনার বালা দুটি তার দোকানের নয় বলে দাবী করেন।
এর আগে নীরেন্দ্র নাথ কর্মকার দুলালের উত্থানের গল্প শুনতে এই প্রতিবেদক গিয়েছিলেন তার জন্মভিটা সমসপাড়া গ্রামে। সেখানে জনশ্রুতি রয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাড়ির পেছনে ডোবা খননকালে পরিত্যাক্ত অবস্থায় একটি স্বর্ণের মূর্তি পেয়েছিলেন তারা। এরপর থেকেই তাদের পরিবারের ভাগ্য বদলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী জানান, অনিমা জুয়েলার্স’এর মালিক বর্তমানে এতইটাই বৃত্তবান ও প্রভাবশালী যে মেগাসিটি মুম্বাইতে স্বর্ণ প্রদর্শনী হলে তার জন্য একটি স্টল বরাদ্দ থাকে। সেখানে কত টন সোনা প্রদর্শন করেন তার হিসাব কে রাখে? রাজস্ব ফাঁকিসহ দেশের অর্থ বহির্বিশ্বে পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অনিমা জুয়েলার্সের স্বত্তাধিকারী ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির নাটোর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি নীরেন্দ্র নাথ কর্মকার দুলাল এধরনের এসব অভিযোগকে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দাবী করে বলেন,আমাদের এই প্রতিষ্ঠানে কোনরকম প্রতারণা করা হয় না। দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা এই শহরে সুনামের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছি। আমাদের সুনাম ক্ষুন্ন করতে এধরনের মিথ্য অভিযোগ তুলে প্রপাকান্ডা চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি নাটোর জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক ভবেশ চক্রবর্তী ভক্ত বলেন, শতকোটি টাকার মালিক অনিমা জুয়েলার্স’ এ ধরনের প্রতারণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। এত সম্পদের মালিক হয়ে সামান্য অর্থের স্বর্নালংকার বিষয়ে তারা প্রতারনা করবেন বলে বিশ্বাস হয়না।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, একজন গ্রাহক তাকে মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন। অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রতারক যত বড়- আর যতই শক্তিশালী হোক, তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *