পথেই শেষ হল কর্মস্থল!

 

পিপলু ও আশরাফ,নাটোর অফিস
জসীমুদ্দিন (৪২) কাজ করেন ঢাকার একটি পোশাক কারখানায়। ঈদের ছুটিতে বাড়ী এসেছিলেন। লকডাউনে পরিবহন না থাকায় ফিরতে পারছিলেন না কর্মস্থলে। কিন্তু কর্মস্থল থেকে ফোনে বারে বারে তাড়া দেয়া হচ্ছিল তাকে। তাই বাধ্য হয়ে পিকআপে চড়েই রওনা হয়েছিলেন ঢাকার পথে। কিন্তু সেই যাত্রা আর কর্মস্থল পর্যন্ত পৌঁছালো না। এছাড়া বাবা-মাকে হারিয়ে এতিম হয়েছে শিশু আকলিমা খাতুন কোল হারিয়েছে বাবা আফফান ও মা আরিফা বেগমের। বাবা-মার কোলে চড়ে এসে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চাচীর কোলে ফিরে যেতে হয়েছে শিশু আকলিমা খাতুনকে। শিশু আকলিমার বাবা আফফান ঢাকায় ফেরি করে কুষ্টিয়ার খাজা বিক্রি করতেন। বিধিনিষেধে বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গ্রামে ফিরে যান। কিন্তু জীবিকার তাগিদে বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার আগেভাগেই ঢাকায় ফিরছিলেন স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু পথেই সব শেষ।
পথেই নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে কাছিকাটা টোলপ্লাজা এলাকায় তাদেরকে বহনকারী মিনিট্রাক অপর ট্রাকের সাথে অভারটেক করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে পাশের জমিতে পড়ে যায়। এতে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই জসীমুদ্দিনসহ নিহত হন পাঁচজন। আর আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান আরও একজন। জসীমুদ্দিন মেহেরপুরের গাংনি থানার সাহাবাড়ি এলাকার জাহানবীর ছেলে। কথা গুলো জানালেন নিহতের ভাই সাইফুদ্দিন । অপর নিহতরা হলেন, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর এলাকার মৃত নাহারুল ইসলামের ছেলে শহিদুল ইসলাম (২৫), একই গ্রামের মৃত শমসের মোল্লার ছেলে আফফান আহমেদ (৫২) ও তার স্ত্রী আরিফা খাতুন (৪০) এবং টাঙ্গাইল সদর থানার মতিয়ার রহমানের ছেলে আল মামুন । অবশিষ্ট একজনের পরিচয় জানা যায়নি। তার পরিচয় সনাক্তের জন্য সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিটকে ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বনপাড়া হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মোজাফ্ফর হোসেন।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থাণীয় আবুল হোসেন বলেন, আমরা বাড়ীতে দুপুরের খাবার খেতে বসেছি। এমন সময় বিকট শব্দ সাথে চিৎকার শুনে দৌড়ে বের হয়ে দেখি যাত্রী বোঝাই একটি মিনি ট্রাক মাঠের কাদাপানিতে পড়ে আছে। এসময় ফায়ার সার্ভিসে ফোন দেয়ার পাশাপাশি তাদেরকে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করি। এরমধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল পরে বনপাড়া হাইওয়ে থানার দল এসে হাজির হয়। তারা ঘটনাস্থল থেকেই একে একে ৫টি লাশ উদ্ধার করেন। বড়ই মর্মান্তিক ঘটনা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মিনি ট্রাকে যাত্রী বহনের ফলেই এমন প্রাণ হানির ঘটনা ঘটেছে।
বনপাড়া ফায়ার ষ্টেশানের ইনচার্জ আকরামুল হাসান বলেন, ধারণা করা হচ্ছে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী যাত্রীদের নিয়ে যাচ্ছিল মিনি ট্রাকটি। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ওই মিনি ট্রাকে চেপেই ঢাকা যাচ্ছিলেন তারা। মিনি ট্রাকটি অপর একটি ট্রাকের সাথে অভার টেকিংয়ের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে খাদে পড়ে যায়। এতে চাপা পড়ে ৫ যাত্রী ঘটনাস্থলেই মারা যান। অপরজনকে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায়। এসময় আহত পাঁচজনকে গুরুদাসপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অপর চারজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
বনপাড়া হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, লাশ গুলো উদ্ধার করে বনপাড়া হাইওয়ে থানায় রাখা হয়েছে। একই সাথে নিহতদের স্বজদের সন্ধান করা হচ্ছে। লাশ শনাক্তের জন্য সিআইডির ক্রামইম সিন ইউনিটকে ডাকা হয়েছে। দূর্ঘটনা কবলিত মিনি ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে।
গুরুদাসপুরের ইউএনও তমাল হোসেন বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ এবং পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা। এসময় জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ আহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসার নির্দেশ এবং নিহতদের দাফন কাজ সম্পন্ন করার জন্য এককালীন ২৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেন। নিহতদের মধ্যে ৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। একজন এখনও অজ্ঞাত। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের জাহাননবীর ছেলে জসিম উদ্দিন (৪২), কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর এলাকার মৃত নাহারুল ইসলামের ছেলে শহিদুল ইসলাম (২৫), একই গ্রামের মৃত শমসের মোল্লার ছেলে আফফান আহমেদ (৫২) ও তার স্ত্রী আরিফা খাতুন (৪০), ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সরাতৈল গ্রামের মৃত মতিয়ার রহমানের ছেলে আল মামুন (৩৩)। নিহত অপর এক মহিলার (৩০) পরিচয় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি
থামেনি ট্রাকে যাত্রী পরিবহন ঃ মিনি ট্রাক দূর্ঘটনায় ৬ জনের প্রাণহানি ঘটলেও থামেনি ট্রাক-পিকআপে যাত্রী পরিবহন। যখন কাছিকাটায় মিনি ট্রাক উল্টে নিহতদের লাশ উদ্ধার কাজ চলছিল তখনও দেখা যায় ট্রাক বোঝাই যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে ঢাকার পথে। বনপাড়া হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, যাত্রীরা অনেকটা নিরুপায় হয়েই ট্রাকে যায়। তথাপি হাইওয়ে পুলিশের চেক পোষ্ট বসানো আছে। কিন্তু যাত্রীরা পুলিশ দেখলে ট্রাক থেকে নেমে হেটে পার হয়ে আবার ট্রাকে উঠে। তাই আমাদের কিছু করার থাকে না।

 

 

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *