নাটোরের গণমাধ্যমে ‘কারাগার’ শিরোনাম, নেপথ্যে কী?

নাটোর অফিসঃ হঠাৎ করেই নাটোর জেলার গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন জেলা কারাগারের সুপার আব্দুল বারেক। তার বিরুদ্ধে নাটোর কারাগারে ভয়াবহ সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে।

উত্থাপিত এসব অভিযোগ করেছেন এমন ব্যক্তিরা যারা কোনাে না কোনো সময় হাজতি হিসেবে কারাগারে থেকেছেন।

তবে এসব অভিযোগ করা হয়েছে সাংবাদিকদের কাছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের আওতাধীন কারা প্রশাসনের নিকট জেলা পর্যায়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীর্তির ব্যাপারে অভিযোগ করার সুযোগ কম যেখানে জননিরাপত্তা বিভাগের আওতাধীন কোনো পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ বরাবর অভিযোগ করা সহজ।

জেলা থেকে প্রকাশিত অনলাইন গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, সুপার আব্দুল বারেক যোগদানের পর থেকেই নাটোর কারাগারের হাজতি এবং কয়েদিদের জিম্মি করে রমরমা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, হাজতি-কয়েদিরা আব্দুল বারেকের সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানালে নির্যাতনের শিকার হয়।

তবে দীর্ঘসময়(৫ থেকে ১০ বছর) কারাবরণ করা কয়েকজন ব্যক্তি জানান, কোনো বিশেষ কর্মকর্তার কারণে নয়, বরং কারাগারে নানা অনিয়ম সবসময়ই বিদ্যমান।

সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ও হাজতির বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, কারাগারে ২৫ টাকা কেজির পেঁয়াজ ১০০ টাকা, ২০ টাকার আলু ১০০টাকা, ৩৫ টাকা হালির ডিম ১৪০ টাকা, ১৫০ টাকার তেলাপিয়া মাছ ৬০০ টাকা, ১৮০ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগির মাংস ৬০০ টাকা, ৩০০ টাকার দেশি মুরগি ৭০০ টাকা, ৪৫০ টাকার গরুর মাংস ১১০০ টাকা, ডারবি সিগারেট ৬৫ টাকার প্যাকেট ১১০ টাকা, ১২০ টাকার সিগারেট ২০০ টাকা, আকিজ বিড়ি ১৭ টাকার স্থলে ৪০ টাকা, ৫৫ টাকার চিনি ১১০ টাকা ও ৪০ টাকা কেজির আতপ চাল ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এছাড়া এক প্যাকেট গোল্ডলিফ বাইরে ২০০ টাকার স্থলে ৩৫০ টাকা, এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট (ছোট) ১৩০ টাকার স্থলে নেয়া হয় ২৩০ টাকা। কারা কর্তৃপক্ষের নতুন নিয়ম, ভেতরে পরিধেয় জামাকাপড় বাহির থেকে নেয়া যাবে না। তাই ক্যান্টিন থেকেই কয়েদিদের কিনতে হয় জামা কাপড়। ১৫০ টাকার লুঙ্গী ৪০০ থেকে ৫০০টাকা, ১৫০ টাকার টাউজার ৪০০ টাকা,৮০-৯০ টাকার গামছা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, ২৫০-৩০০ টাকার বিছানার চাদর ৬০০ টাকা, রান্না করা প্রতি কেজি গরুর মাংস ১১০০টাকা, কক মুরগী প্রতি কেজি ৭০০টাকা, বয়লার মুরগী ৪৫০ টাকা,ডিম প্রতি পিস ৩০ টাকা, ভাত ১ কেজি ৩৫০ টাকা, ১০ টাকার শপিং ব্যাগ ৯০ টাকা। কারাবন্দিদের প্রতিদিন সকালে আধাসেদ্ধ ১ পিস আটার রুটি ও কম দামের সামান্য গুড়, দুপুরে সামান্য ভাত ও আধা সেদ্ধ ডাল, রাতে ভাতের সঙ্গে আধাসেদ্ধ সবজী, ১০-২০ গ্রাম ওজনের এক টুকরো পাঙ্গাস মাছ দেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী মাছের জাত পরিবর্তন করার কথা থাকলেও প্রতিদিনই পাঙ্গাস মাছ খাওয়ানো হয় বন্দীদের।

প্রতিবেদনগুলোতে দাবী করা হয়েছে, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ বিশেষ দিবসে সকল কারাবন্দিদের জন্য উন্নতমানের খাদ্য দেয়ার কথা থাকলেও নাটোর জেলা কারাগারে তা হয় নামমাত্র। বাজারের পচা সবজি বন্দিদের জন্য মসলা ছাড়াই আধাসেদ্ধ করে দেয়া হয়।

সংবাদগুলোতে হাজতিদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, কারাগারের ভেতরে পরিবেশিত খাবার খাওয়ার অযোগ্য। বন্দীদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা কারাগার ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে খায়।

চয় মাস কারান্তরীণ থাকা নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের ব্যবসায়ী মো. নুরুল ইসলাম প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, তিনি অন্তরীণ থাকাকালীন একদিনের জন্যও জেলের কিছু খেতে পারেননি।

বড়গাছার বাসিন্দা রানা প্রামাণিক জানিয়েছেন, কারাগারে একটু ভালো থাকার জন্য এতো বেশি টাকা খরচ করতে হয় যে, সেই টাকা তোলার জন্য কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার অপরাধমূলক কাজে জড়াতে হয়।

তবে এসব ব্যাপারে কারা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরেজমিন অনুসন্ধানের আহ্বান জানানো হয়েছে।

অভিযুক্ত জেল সুপার আব্দুল বারেক বলেন, “আমি কোনো অনিয়ম করিনি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার বিরুদ্ধে হঠাৎ করে মিথ্যাচার করা হয়েছে। আমি প্রশাসন ভালো চালাচ্ছি। কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন থাকলে সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখে যেতে পারেন।”

তবে একটি সূত্র জানাচ্ছে, নাটোর কারাগারে চারটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে যাদের মধ্যে কারাগারের শীর্ষ কর্মকর্তা, হাজতি ও নিরাপত্তাকর্মীরা রয়েছে। কোনো বিষয়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তারা অন্তদ্বন্দ্বে ভুগছেন। সমঝোতার ভিত্তিতে এতোদিন কাজ করতেন বলে কারাগারের ভেতরের খবর বাইরে আসতো না। এখন তাদের বিরুদ্ধাচারণ তাদের অনৈতিক কার্যক্রমগুলো প্রকাশ করছে।

কারাগারের মতো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার একটি জায়গা সম্পর্কে বাইরে ভালো বা মন্দ ধারণা প্রকাশিত হলে তা সম্ভাব্য অপরাধীদের উৎসাহিত করে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মাহাবুব আলম। তিনি বলেন, “একজন বিত্তশালী সুযোগসন্ধানী অপরাধী যদি মনে করেন কারাগারে অর্থের বিনিময়ে ভোগ-বিলাসিতার সুযোগ বিদ্যমান, তবে তিনি নির্দিধায় অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে পারেন। কারা অভ্যন্তরে যদি এহেন কোনো ঘটনা ঘটেও থাকে, তবে সেজন্য সরকারের গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা গ্রহণের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করা যায়।”

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *