নাটোরে ক্ষোভের আগুনে পোড়ানো হলো মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি!

নাটোর অফিস॥
শুত্রবার দিনগত রাত যেন এক বিভীষিকা হয়ে নেমে এসেছিলো নাটোর শহরের ঝাউতলা বস্তির প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীনের বাড়িতে। নাটোর শহরের ঝাউতলা বস্তি এলাকায় প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিনের বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এসময় পাশের রিক্সা চালক মজিদের বাড়িও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এলাকাবাসী জানায়,শুক্রবার রাত ১টার দিকে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা নাসিরের পরিবারের অভিযোগ, শহরের কান্দিভিটা এলাকার বাসিন্দা যুবলীগ কর্মী নাজমুল শেখ বাপ্পী ওরফে হাড্ডি বাপ্পী ও তার সহযোগীরা প্রাইভেট কারে করে এসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। হাড্ডি বাপ্পীর নানা অপকর্মের প্রতিবাদ করায় আক্রোশে তারা এ আগুন লাগানো হয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেন। পরে পুলিশ ওই প্রাইভেট কার জব্দ করে থানায় নিয়ে গেছে।

মুক্তিযোদ্ধা নাসিরের ছোট ছেলে পরিবহন শ্রমিক ও ১ নং ওয়ার্ড যুবলগী প্রচার সম্পাদক আকরাম উদ্দিন বলেন,যুবরীগ কর্মী নাজমুল শেখ বাপ্পী ওরফে হাড্ডি বাপ্পী নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে আমাদের এলাকায় এসে আধিপত্য বিস্তার করে। তারা নারী নির্যাতন,ধর্ষন,অবৈধ দখলসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। প্রতিবাদ কারীকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হত। তিনি নিজে এসবের প্রতিবাদ করায় তাকে সহ তার পরিবারের সকলকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল হাড্ডি বাপ্পী,তার সহযোগী মামুন,কালু,নির্জন,কাওছার,আকাশ,মকলেস,শাকিল ও আশরাফুল। শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাড্ডি বাপ্পী ও তার দল তাদের ব্যবহৃত একটি প্রাইভেট কারে ( ঢাকা মেট্রো-খ ১২-৮৮৪৩) এসে আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যায়। আগুন থেকে বাঁচতে পরিবারের লোকজনকে প্রাচীর টপকিয়ে পাশের হর্টিকালচার সেন্টারের মধ্যে নিয়ে যাই। তিনি দাবী করেন, বাপ্পী ও তার দল পেট্রোল ঢেলে তার বাড়িতে আগুন দিয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা নাসিরের স্ত্রী অকলিমা বেগম বলেন, বাপ্পীরা তার ছেলেসহ আমাদের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল। তারা আমাদের মেরে ফেলতে ঘুমন্ত অবস্থায় বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও জমির দলিল,নগদ ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, সোনার গহনা,আকরামের একটি মোটর সাইকেল সহ প্রায় ৮ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। তারা এখন এক কাপড়ে খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন। তিনি এর সাথে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবী জানান।

প্রতিবেশী আব্দুল মজিদ ও তার স্ত্রী মঞ্জুয়ারা জানান, তারা ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ঘরের মধ্যে আগুন দেখতে পাই। জীবন বাঁচাতে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যাই। সমিতি থেকে ওঠানো ঋনের ৪৫ হাজার টাকা সহ তাদের সর্বস্ব পুড়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে আকরামের সাথে হাড্ডি বাপ্পীর গন্ডগোল চলছিল।

অপর প্রতিবেশী নয়না জানান,অনেক রাতে আগুন জ্বলতে গেছে সন্তানদের নিয়ে তিনি বাড়ির পাশে ডোবায় ঝাঁপ দিয়ে প্রান বাঁচিয়েছেন।

কুলসুম নামে এক নারী জানান,হাড্ডি বাপ্পী ও তার দলের অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। তারা আমার পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দখল করে। থানায় অভিযোগ করা হয়েছে।

অভিযুক্ত যুবলীগ কর্মী নাজমুল শেখ বাপ্পী বলেন, আমি ও আমার সমর্থকরা এ ধরনের নোংড়া নৃশংস কাজ করতেই পারি না। আমাকে রাজনৈতিক ভাবে হেয় করতে ও আমার অনুসারীদের বিপদে ফেলতে এ ধরনের মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। তদন্ত হলেই সত্যতা বের হয়ে আসবে।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সুত্রে জানাযায়, নাটোর শহরের ঝাউতলা বস্তি এলাকায় ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ে নিয়ে বাস করতেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন। দু’বছর আগে নাসির উদ্দিন ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে ওই বাড়িতে দুই ছেলে জাহিদুল এবং আকরামসহ নাতি-পুতি নিয়ে বাস করছেন মুক্তিযোদ্ধার বিধবা পত্নী আকলিমা বেগম। ঘটনার দিন বড় ছেলে জাহিদুল তার স্ত্রী ছেলে-মেয়ে সহ শ্বশুড়ালয়ে ছিলেন। শুক্রবার রাতে বিধবা আকলিমা ও ছোট ছেলে আকরাম ও নাতি-নাতনি বাড়িতে ছিলেন। রাতে খাওয়া দাওয়া করে সবাই ঘুমাতে যান। রাত ১টার দিকে ঘরে আগুন জ্বলতে দেখে জীবন বাঁচাতে সবাই প্রাচীর টপকে বাড়ির পার্শ্বে জেলা হটিকালচার সেন্টারের মধ্যে চলে যান। প্রতিবেশীদের অনেকেই ছেলে-সন্তানদের নিয়ে পাশের একটি জলার পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষা করেন। খবর পেয়ে নাটোর ফায়ার স্টেশন কর্মীরা ঘটনাস্থলে যায় এবং তাদের দু্িট ইউনিট এক ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রনে আনে। বর্তমানে পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।

নাটোর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শহিদুল ইসলাম ও লিডার মখলেছুর রহমান বলেন, খবর পাওয়ার পর রাত ১টার দিকে দুটি ইউনিট গিয়ে ঘন্টা ব্যাপী চেস্টা চালিয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছি। আগুনে ওই দু’টি বাড়ির ৮টি বসত ঘর পুড়ে ভস্মিভুত সহ প্রায় ৬ লক্ষাধিক টাকার মামলামাল পুড়ে গেছে। তবে পেট্রোল দিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে কিনা সেবিষয়ে আমরা স্পস্ট নয়।আমরা বৈদ্যুতিক শট-সার্কিটে আগুনের সূত্র উল্লেখ করে ঢাকায় রিপোর্ট পাঠিয়েছি।

এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধ নাসির উদ্দিনের বাড়িতে আগুন লাগানোর খবর পেয়ে পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা,অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত,ওসি কাজী জালাল উদ্দিনসহ পুলিশের অন্যান্য উর্ধন কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহাঙ্গীর আলম, পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি,ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন, জেলা আওয়ামীলীগ যুগ্ম সাধারন সম্পাদক সৈয়দ মোতৃুজা আলী বাবলু, ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সভাপতি সুজিত কুমার সরকার ,মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নবীউর রহমান পিপলু শনিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্মন করেন।

এসময় পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি ক্ষতিগ্রস্থ তিনটি পরিবারকে তাৎক্ষনিকভাবে ৫ হাজার টাকা করে এবং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সভাপতি সুজিত কুমার সরকার দুই হাজার টাকা করে আথিৃক সহায়তা করেন।

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন জানান, এলাকার আধিপত্য নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে হাড্ডি বাপ্পীর সাথে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আকরামের বিরোধ চলে আসছে।পুর্ব বিরোধের জেরে এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

জেলা আওয়ামীলীগ যুগ্ম সাধারন সম্পাদক সৈয়দ মোতৃুজা আলী বাবলু বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। প্রমান মিললে কেউ ছাড়া পাবেনা। বিষয়টি জেলা আওয়ামীলীগ সেক্রেটারি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলকে জানানো হয়েছে।

পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের ওপর এমন নৃশংস বা বর্বরোচিত ঘটনা মেনে নেওয়া যায়না। জড়িতদের দৃষ্টান্তমুলক মাস্তি হওয়া দরকার। ঘটনাটি পুলিশ তদন্ত করছে।

পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, ঘটনার খবর পাওয়ার পর পরই ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। আমিসহ পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর সাথে জড়িত যেই থাকবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রাইভেট কার থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গাড়ির মালিককে ডাকা হয়েছে।

এদিকে পরে জেলা প্রশাসক মোঃ শাহরিয়াজ ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মধ্যে ৩৩ হাজার টাকা,১১ বান্ডিল ঢেউ টিন,১০টি কম্বল,৫ প্যাকেট খাবার সহ চাল,ডাল ও ভৈজ্য তেল বিতরন করেন। এসময় সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন প্রমুখ সরকারী কর্মকর্তা ও পৌর মেয়র উপস্থিত ছিলেন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *