নাটোর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে হচ্ছেটা কি?

নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান
নাটোরের সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠায় আলোচনার ঝড় বইছে। ঘটনার সাথে জড়িত একজন শিক্ষককে পুলিশ গ্রেফতারের পর এই সরকারী বিদ্যাপিঠ এখন জেলার ‘টক অব দ্যা টাউন’। এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরের অনেক খবর এখন বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্যালয়ের ভিতর মাদক বিক্রি ও সেবনেরও অভিযোগ উঠেছে । এ নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় রয়েছেন অভিবাবকরা। এসব নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনও বেশ তৎপরতা শুরু করেছে। অভিভাবক সহ সাধারন মানুষের জিজ্ঞাসা“সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে হচ্ছেটা কি?

চাপের মুখে এসব ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করতে আগামীকাল সকাল ১০টায় জেলা, প্রশাসন ও পুলিশ বিদ্যালয়টিতে গণশুনানির আয়োজন করেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ভর্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে কোচিং বাণিজ্যের বীজ বপন করা হয় যে প্রতিষ্ঠান থেকে, তার নাম নাটোর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি কখনই লাগাম টানতে পারেনি এখানে কর্মরত কতিপয় কোচিংবাজ শিক্ষকদের। এতে সেসব শিক্ষকরা বেপরোয়া হয়ে উঠে দিনের পর দিন। জেলা প্রশাসনের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না থাকায় প্রতিষ্ঠানে তৈরী হয় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট যা পাশ্ববর্তী একটি কোচিং সেন্টার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শুরুটা তখন থেকেই। ‘টক অব দ্যা টাউন’ হিসেবে আলোচনায় ওঠা এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরের অনেক খবর এখন বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। একসময় প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে কতিপয় শিক্ষক-শিক্ষিকার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ সুনির্দিষ্ট হয় যখন ছাত্রীদের ব্যাগ থেকে সিগারেট, গাঁজা, ফেন্সিডিলের মতো মাদকদ্রব্য মিলতে থাকে। এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও কখনই তা আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ফলে অভিভাবকরা শুধুই হতাশা প্রকাশ করেছেন সে সময়।

সম্প্রতি (২৬ আগস্ট) তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গ্রেফতার হন স্কুলের শারীরিক শিক্ষা শিক্ষক আব্দুল হাকিম। তার বিরুদ্ধে ওই শিশুকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনা হয়। এ ঘটনার পর বের হতে থাকে আরো অনেক ঘটনা। ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে প্রাক্তন এক ছাত্রীর গণিতের শিক্ষক সাইফুল ইসলামে কথোপকথন। কথোপকথনে শিক্ষক সাইফুল ওই ছাত্রীকে সরাসরি যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। এর জন্য তার স্ত্রীকে সে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ারও কথা বলে। সাইফুল জানায়, ছাত্রীটিকে পাবার জন্য তার চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এজন্য ছাত্রীর শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গের ছবিও চান তিনি। এই ঘটনার বর্ণনা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ওই ছাত্রীর এক সহপাঠীর উপর বেজায় চটে যান সাইফুল। ছাত্রীটিকে মন্তব্য প্রত্যাহারে রাজী করাতে এসে গণপিটুনির শিকার হন তিনি। এঘটনা বিদ্যালয় পর্যন্ত গড়ালে ছাত্রীদের পরিবারের সদস্যদের পায়ে ধরে মাফ চেয়ে পার পেয়ে যান তিনি। তবে পুলিশ তাকে ডেকে নিয়ে সতর্ক করে।

পরপর এমন দুইটি ঘটনায় বিব্রত বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরা। আর চরম আস্থাহীনতায় রয়েছেন অভিভাবকরা। আর নাটোরের সাধারণ মানুষ বলছেন, ছাত্রীদের ভবিষ্যত নিরাপত্তায় প্রতিটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পুরুষ শিক্ষক পদায়ন বন্ধ করতে। এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়।

জানা যায়, বর্তমানে বিদ্যালয়ের প্রভাতী ও দিবা মিলে দুই শিফ্টে ছাত্রীর সংখ্যা ১৯৩৪ জন। ৫০ জন শিক্ষকের বিপরীতে এখানে রয়েছেন ৪১ জন শিক্ষক। যাদের মধ্যে পুরুষ ২৪ ও নারী ১৭ জন। এছাড়া একজন প্রধান শিক্ষক ও দুইজন সহকারী প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল মতিন।

ছাত্রীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগে শারীরীক শিক্ষক আব্দুল হাকিম গ্রেফতারের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষিকা নাজনীন আক্তার, আঞ্জুমান আরা এবং মোতালেব হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ৩ কার্যদিবস শেষে প্রতিবেদন দিয়েছে। ওই কমিটি শিক্ষক হাকিমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ‘কিছুটা’ সত্যতা পেয়েছে।

তবে এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গণিতের শিক্ষক সাইফুলের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ সামনে এলে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। জেলা পুলিশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কারনে বিপাকে পড়ে যায় বিদ্যালয় প্রশাসন। সাইফুলের ঘটনা তদন্তে আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আগের কমিটির সদস্যদের সাথে তদন্ত কাজ সমন্বয় করছেন সহকারী প্রধান শিক্ষক দিল মাহমুদা খাতুন। আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কমিটিকে চাপের মুখে বিদ্যালয়ে একটি অভিযোগ বাক্স খোলা হয়। তবে প্রধান শিক্ষকের দাবী, অভিযোগ বক্সে ‘ফ্যান নষ্ট’, ‘পানির সমস্যা’ মতো খুবই নগণ্য অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নয়।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন জানান, যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সকল শিক্ষককে চিঠি দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলোর কোন অভিযোগ নেই শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকের। ফলে সহজে তাদের পার পেয়ে যাবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ না থাকায় পুলিশও সতর্ক করা ছাড়া আর কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

বিদ্যালয়টির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, যৌন হয়রানির কোন অভিযোগ না থাকায় শিক্ষক হাকিমের মতো পরিণতিবরণ করতে হবে না সাইফুলের। এই সুযোগে সাইফুলকে অন্যত্র বদলী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাইফুলকে ৭দিনের মধ্যে বদলী করা হবে, এমন প্রতিশ্রুতি দেয়ার কারণেই নাকি তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না করতে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে চাপ দিয়ে রাজী করিয়েছে একটি প্রভাবশালী মহল। তবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে জানিয়েছেন, সাইফুলকে বদলী করার বিষয়টি তার জানা নেই। তার স্বাক্ষর ছাড়া সাইফুল বদলী হতে পারবেন না বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি বিদ্যালয়ে মাদক ব্যবসার অভিযোগও তদন্ত করার আশ্বাস দেন তিনি।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ ও যৌন হয়রানি নির্মূল কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অভিযোগকারীর অভাবে যৌন নিপীড়ক শিক্ষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, হাওয়ায় ভাসা অভিযোগে নিপীড়কদের টিকিটিও ছোঁয়া যাবে না। সাহস করে অভিভাবক ও ভুক্তভোগী এগিয়ে না এলে বিচার চাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। শুধুশুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষ দেয়া উচিত না।

নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকরামুল ইসলাম বলেন, এই বিদ্যালয়ের ব্যাপারে অনেক কথা আমাদের কানেও এসেছে। তবে অভিযোগ আকারে নয়। তাই কর্তৃপক্ষকে আমরা সতর্ক করে ৭দিনের সময় দিয়েছি সবকিছু ঠিক করার জন্য। আমরা পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখছি। এর অন্যথা হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া বিদ্যালয়ে মাদক ব্যবসা ও সেবন হয় কিনা সে ব্যাপারে আমরা খোঁজ করছি। এ ব্যাপারে তথ্য দিলে আমাদের কাজ সহজ হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *