নাটোরে থমথমে দত্তপাড়ায় শোকের মাতম, আহাজারি

নাইমুর রহমান, দত্তপাড়া ঘুরে
পেশায় দর্জি হাসান আলী স্থানীয় মোকরামপুর বাজারে শুরু করেছিলেন পানের ব্যবসা। তখন তার ব্যবসায়ীক অংশীদার হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ সেন্টু। একসময় পানের পাশাপাশি শিমের ব্যবসা শুরু করেন হাসান আলী। কিন্ত সেই ব্যবসায়ে অংশীদার করেননি সেন্টুকে। তখন থেকেই বিরোধ সাবেক দুই ব্যবসায়ীক অংশীদারের। সময়ের পরিক্রমায় হাসান আলী বড়হরিশপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ও সেন্টু ওই ইউপির সদস্য।

বৃহষ্পতিবার (১৪ই ফেব্রুয়ারী) সন্ধ্যায় নাটোর শহরের দত্তপাড়া বাজারে হাসান আলীকে কুপিয়ে হত্যা করে সেন্টুর দুই সমর্থক সজীব ও সোহান। হাসানের বাম হাত, পিঠ, কোমড় বরারবর মেরুদন্ডে, হাঁটুর নীচে ও দুই পায়ের রগে অন্তত ২৫টি ধাঁরালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত কারণে নাটোর থেকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে নেয়ার পথে বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়।

শুক্রবার দুপুরে নিহত হাসানের বাড়িতে এসে সমবেদনা জানান নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম। এসময় দলীয় কর্মী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন তিনি।

এদিকে, হাসান আলীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে পুরো দত্তপাড়া এলাকায়। পাশাপাশি এলাকাজুড়ে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। শহরের ব্যস্ততম এ এলাকায় শুক্রবার খোলা হয়নি কোন দোকানপাট, বসেনি স্বাবাবিক দিনের মতো বাজার-হাট। শুক্রবার বিকেলেও পুরো এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হাসান ছিলেন চতুর্থ সন্তান। শুক্রবার সকালে নিহত হাসানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বুক চাপড়ে কাঁদছেন হাসানের স্ত্রী আয়েশা বেগম। বড়বোন হাসিনা বেগম ভাইয়ের শোকে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন। মা হাজেরা বেগম ছেলের মৃত্যুতে ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। আর শৈশব থেকে সন্তানের স্নেহে দেবর হাসানকে লালন-পালন করা ভাবী আলেয়া বেগমের বিলাপ ভারী করে দিচ্ছে আশপাশের পরিবেশ।

পুলিশ বলছে, হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া সজীব ও সোহান একই এলাকার রিয়াজুল ইসলামের ছেলে। তারা একটি হত্যা মামলার আসামী। এক সপ্তাহ আগে জামিনে মুক্ত হয়। মুক্তি পেয়েই তারা পরিকল্পিত এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।

জানা যায়, হত্যার আগে বৃহষ্পতিবার সারাদিন সেন্টুর নেতৃত্বে সজীব ও সোহান হাসান আলীকে নজরদারীতে রাখে। দিনশেষে দত্তপাড়া বাজারে একটি চা দোকানে এসে বসলে পেছন থেকে উপর্যুপরি কুপিয়ে হাসানকে গুরুতর আহত করে সজীব ও সোহান। পরে হাঁসুয়া উচিয়ে বীরদর্পে বাজার থেকে বেরিয়ে আসে তারা। ভরা বাজারে এসময় হাসান আলীকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। উল্টো পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ এড়াতে যে যার মতো দেকানপাট বন্ধ করে সড়ে পড়ে।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী ভ্যান চালকের বরাত দিয়ে নিহত হাসানের ভাই আবু ইউসুফ জানান, সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে তার ভাই হাসানকে সজীব ও সোহান কুপিয়ে ফেলে রেখে গেলে ইউপি সদস্য সেন্টু মোটরসাইকেলে করে ওই দুজনকে হরিশপুর পার করে দিয়ে আসে। লোকজন এগিয়ে এলে তার ভাইকে বাঁচানো যেত।হাসানের পরিবারের দাবী, পূর্ব বিরোধের জেরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও হাসানের সাথে বিরোধে জড়ান সেন্টু। সেই বিরোধ মারামারি পর্যন্ত গড়ায়। তখন স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বিরোধ মিমাংসার ব্যবস্থা করলেও সেন্টুর ক্ষোভ ছাইচাপাই থেকে যায়। বৃহষ্পতিবারের হাসানের হত্যাকান্ডের নির্দেশদাতা ও প্রত্যক্ষ সহযোগি ইউপি সদস্য সেন্টু। হত্যাকান্ডের দিন সকালে হাসান পাশ্ববর্তী লক্ষীপুর ইউনিয়নে তার মামাশ্বশুরের মাছের ঘের দেখতে গেলে তখন থেকেই পিছু নেয় সেন্টু, সোহান ও সজীব। তারা সেখানেই হাসানকে কোপানোর পরিকল্পনা করে। তবে পুরোটা সময় মামাশ্বশুর সাথে থাকায় তারা হামলার সুযোগ পায়নি। মৃত্যুর আগে হাসান এসব কথা বলে গেছেন, দাবী পরিবারের।

এলাকাবাসীর দাবী, পুরো হরিশপুর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ইউপি সদস্য সেন্টু আর তার দুই সহযোগি সোহান ও সজীব। এলাকায় প্রতিটি অপকর্মের সাথেই তারা তিনজনের কেউ না কেউ জড়িত। বছরদুয়েক আগে শহরের কানাইখালীতে এক কাঁচ ব্যবসায়ীকে হত্যা মামলার মূল আসামী ছিলেন সজীব ও সোহান। তারা কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় এলাকায় কোণঠাসা ছিল ইউপি সদস্য সেন্টু। সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়ে আবারো পুরো এলাকা দাঁপিয়ে চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু করে। যে তাদের অপকর্মের প্রতিবাদ করে, তার উপরই খড়গ নেমে আসে অত্যাচারের।

পরিবারের পক্ষে হাসানের বড়ভাই শহীদুল ইসলাম ভাই হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করে বলেন, শুধু সেন্টুর অন্যায়-অপকর্মের প্রতিবাদ করায় তার ভাইকে জীবন দিতে হল। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসনের নিকট ইউপি সদস্য সেন্টু ও তার দুই সহযোগির দুঃশাসন থেকে দত্তপাড়াবাসীকে বাঁচানোর দাবী জানান।
বড়হরিশপুর ইউপি চেয়ারম্যান ওসমান গণি হাসান আলী হত্যাকান্ডকে দুঃখজনক মন্তব্য করে বলেন, এ ঘটনায় তার পরিষদের কেউ জড়িত থাকলে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া হোক।

নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(সদর সার্কেল) আবুল হাসনাত বলেন, হত্যাকান্ডের সাড়ে জড়িতদের দুইজন একটি হত্যা মামলারও আসামী। সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকায় এসেই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তারা। ঘটনার পর থেকে সকলেই সবাই পলাতক রয়েছে। তাদের খুঁজতে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে।

নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল বলেন, হাসান হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবে। এজন্য যা যা করনীয় সব করা হবে। অপরাধ করে কেউ রেহায় পাবে না।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *