নাটোরের ‘লাকি সিট’ নিয়ে বিব্রত আ’লীগ

নাইমুর রহমান, গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম ঘুরে
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ‘লাকি সিট’ হিসেবে দল ও স্থানীয়দের কাছে নির্ধারিত ৬১,নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনটি নিয়ে চরম বিব্রত আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী তফশিল ঘোষণা, মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ, জমাদান এমনকি চুড়ান্ত দলীয় মনোনীত প্রার্থী ঘোষণারও আগ মুহূর্তেও আসনটি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের রাজধানী ও নিজ এলাকায় পারস্পরিক বিষোদগার কোনভাবেই থামছে না। একে অন্যের বিরুদ্ধে বলতে দলের কেন্দ্রিয় নির্বাহী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ একেবারে সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত গেছেন কোন কোন মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাদের এমন তৎপরতায় ক্ষুদ্ধ খোদ কেন্দ্রিয় নেতৃত্ব।
তবে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, এমন অপতৎপরতার জবাব দিতে গিয়ে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন মহাজোটের মনোনয়নে পরিণত হলে তার জন্য দায়ী থাকবেন ওইসব মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
এ আসনে প্রচারণার সাথে পারস্পরিক অপপ্রচার এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিজস্ব বলয়ের কর্মীরাও পরস্পরকে আক্রমণ করছেন এখানে। কোন মনোনয়ন প্রত্যাশীকে নিয়ে তৈরী করা সংবাদ পছন্দ না হলে ফেসবুকে তাদের সক্রিয় কর্মীদের ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন নাটোরের গণমাধ্যম কর্মীরাও।
তুলনামূলকভাবে এ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা দলের সিনিয়র নেতা, বিভিন্ন মন্ত্রী, উপদেষ্টার নিকট থেকে দোয়া নিচ্ছেন উল্লেখ করে নিজেরাই নিজেদের ছবি পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। কেউ আবার বাতুলতার সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে টিভিতে নিজের সাক্ষাতকার প্রচার করিয়ে কর্মীদের দিয়ে জানিয়েছেন যে গণমাধ্যম জরিপেই মনোনয়ন নির্ধারিত হবে।
গত দুই মাসে এ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভোটকেন্দ্রিক তৎপরতা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তুলনামূলকভাবে এ আসনে প্রচারের চেয়ে বেশি হয়েছে অপপ্রচার। আর বছরজুড়েই স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস এমপি ছিলেন জাতীয় পত্র-পত্রিকার শিরোনাম। নিজ এলাকায় দলীয় কর্মীদের অবমূল্যায়নের বিভিন্ন ঘটনায় অনান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অভিযোগের তীর ছিলো তার দিকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গড়িয়েছে রাজধানী পর্যন্তও। সেখানেও গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রামের তৃণমূল নেতাকর্মীদের ব্যানারে তার বিরুদ্ধে মানববন্ধনসহ বেশ কিছু অভিযোগ করা হয়। তবে নিজ এলাকার বাইরে মানববন্ধনের এমন ঘটনায় আব্দুল কুদ্দুসও অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন এ আসনের হেভিওয়েট মনোনয়ন প্রত্যাশী ও গুরুদাসপুর পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা ও বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডাঃ সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে। সাংসদ আব্দুল কুদ্দুসের পক্ষে একাট্টা হয়ে সেসময় এমন অপপ্রচারের প্রতিবাদ করেন দুই উপজেলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও দলীয় কর্মীরা। তারা এটিও মনে করেন, সাংসদ কুদ্দুসই এ আসনে দলের যোগ্য উত্তরসূরী। কুদ্দুসের বিরোধীতা কারীদের বিরুদ্ধে তৃণমূলে দলীয় সুনাম ক্ষুণœ করার অভিযোগও করা হয়।
অন্যদিকে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে মনোনয়ন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ও নৌকা প্রতীকের বিরোধীতাসহ বেশ কিছু অভিন্ন অভিযোগ বছরজুড়েই তুলেছেন গুরুদাসপুর পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা ও বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডাঃ সিদ্দিকুর রহমান। এমনকি গত এক মাসেও তারা একইসাথে নৌকার পক্ষে দলীয় প্রচারণা চালিয়েছেন। তাদের দাবী ছিলো, সাংসদ আব্দুল কুদ্দুস বাদে যে কাউকে মনোনয়ন দিলে তারা তার পক্ষেই কাজ করবেন। সম্প্রতি এ আসন থেকে মনোনয়ন তুলে একই কথা জানিয়েছেন রাবির সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি আহম্মদ আলী মোল্লা। এলাকার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পারস্পরিক বিদ্বেষের বিষয়টি মাথায় রেখে এ আসনে মনোনয়ন কিনেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জজকোর্টের পিপি সিরাজুল ইসলাম। তার দাবী, ওই আসনের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ পরস্পর এমন বিরোধীতায় লিপ্ত হয়েছেন যে তা দলের জন্য ক্ষতিকর। এমন বিভাজনের খেসারত নির্বাচনে দিতে হতে পারে মনে করেন তিনি।
তবে এ আসন থেকে মনোনয়ন দৌড়ে শেষ মুহূর্তে এগিয়ে রয়েছেন কেন্দ্রিয় যুব মহিলালীগের সহ-সভাপতি ও সাংসদ কন্যা কোহেলি কুদ্দুস মুক্তি। ধারণা করা হচ্ছে, এবার বাবার বদলে নাটোর-৪ আসনে দলীয় মনোনয়ন তিনিই পাচ্ছেন।
তবে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মনোনয়ন কিনেই এক বাক্যে বলেছেন, যে দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে তার পক্ষেই তারা কাজ করবেন। তবে প্রকৃত অর্থেই তারা কতটা কাজ করবেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তৃণমূল কর্মীরা।
শনিবার (১৭ই নভেম্বর) বড়াইগ্রামের নগর ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মীদের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের ভাষ্য, বড়াইগ্রামে বেশি আওয়ামী লীগের ভোট। দল যাকে প্রার্থী দেয়, তাকেই ভোট দেন তারা। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এবার বিভাজন এতই বেশি যে, প্রতিবারের স্বাভাবিক পরিস্থিতি এবার অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। তাদেরও একই কথা- ২০০১ সালের মনো দলীয় প্রার্থীর পরাজয় হলে তার জন্য দায়ী থাকবেন বিভাজনকারীরা।
একই দিন গুরুদাসপুর পৌর এলাকার বিএনপি ও জাপার কর্মীরা ফুরফুরে মেজাজে একইসুরে জানিয়েছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল নির্বাচনে তাদের পালে হাওয়া যোগাবে নিঃসন্দহে। তাদের যুক্তি, সাংসদ বনাম অনান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা কেউ কাউকে ছাড় দেবে না। একজন টিকেট পেলে অন্যরা বিরোধীতা করবে।
এসব ব্যাপারে উত্তরাঞ্চলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তদারকির দায়িতে থাকা অন্যতম এক নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। সংবাদে তার নাম প্রকাশ করা হবে না-এমন শর্তে তিনি বলেছেন, ‘পারস্পরিক বিরোধীতাও এক ধরণের প্রচারণা, তবে তা হতে হবে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে, নিজ দলের নয়। মনোনয়ন চুড়ান্ত। ওয়েট এন্ড সি।’
তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীরা মনে করছেন, তুলনামূলকভাবে এ আসনের নির্বাচন হবে অন্যরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। দল শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ না হলে পাল্লা ভারী হবে অন্যদের। তাই আগামী দিনে দলকে বিব্রত না করতে এখন থেকে গ্রুপিং ও রেষারেষি পরিহারের আহ্বান তাদের।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *