নাটোরে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প॥ লাখ টাকার ঘর অর্ধেকে!

নাটোর: ভিটা আছে, কিন্তু মাথা গোঁজার ঘর নেই নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের দবিরের মোড় এলাকার বৃদ্ধ আয়েশ আলী, লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের বিধবা কাজলী বেগম ও কাশেমের মোড় বালুঘাট এলাকার সুমি বেগমের। সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পে ঘর তৈরির জন্য নাম লেখানোর জন্য অনেকের কাছে ছুটে গেছেন। তালিকায় নাম তুলতে টাকাও নেওয়া হয় তাদের কাছে।

অর্ধেক টাকায় আধাপাকা ঘরঃ
লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প তালিকার এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু ঘর নির্মাণ শুরু হলেও তালিকায় নাম নেই তাদের। এদিকে প্রকল্পের হত দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ আধাপাকা ঘর নির্মাণেও চলছে হরিলুট।

প্রতিটি ঘর ও টয়লেট নির্মাণের অনুকুলে লাখ টাকা করে বরাদ্দ হলেও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা ব্যয় করে এসব ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ সুবিধাভোগী সহ এলাকাবাসীর।

এক ইউনিয়নেই ৫৬ ঘরঃ
ঔষধী গ্রাম খ্যাত নাটোরের লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নে সরকারের আ¤্রয়ণ প্রকল্পের ৫৬টি বাড়ি নির্মাণে অনিয়ম-দুনীতিসহ তালিকা তৈরিতে বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া অভিযোগ উঠেছে টাকা নিয়েও তালিকায় নাম দেওয়া হয়নি অনেক দরিদ্র পরিবারের।

এদিকে প্রতিটি ঘর এক লাখ টাকায় করার নির্দেশ থাকলেও তা করা হচ্ছেনা। তবে উপজেলা প্রশ্রাসনের দাবী ঘর নির্মাণ কাজ শেষ না হতেই এমন অভিযোগ সঠিক নয়।

তিন হাজার টাকা দিয়েও নাম উঠেনি আয়েশ আলীরঃ
ঘর বরাদ্দ না পাওয়া দবিরের মোড় এলাকার বৃদ্ধ আয়েশ আলীর বাড়িতে যেতে হলে ফসলি জমির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কলা গাছ লাগানো জমির মধ্যে দিয়ে অনেকদূর যাওয়ার পর দেখা মেলে আয়েশ আলীর বাড়ি। ছনের তৈরী আয়েশ আলীর বাড়ির চারিদিকে ফসলি জমি। আশে পাশে বাড়ি ঘরের দুরুত্ব অনেকটাই। বাড়িতে গিয়েই দেখা মেলে বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া আয়েশ আলী ও তার স্ত্রী আলেকজান বেগমের সাথে। ছনের তৈরি দু’টি ঘরের একটিতে স্বামী-স্ত্রী এবং অপরটিতে থাকে তাদের মানসিক রোগে আক্রান্ত ছেলে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে অথবা চেয়ে চিন্তে চলে তাদের সংসার। মেয়ে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে। সে কিছু টাকা পাঠায় তাদের জন্য। ছনের ছাউনি হলেও দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় দু’টি ঘরের একটি হেলে পড়েছে।

আয়েশ আলী ও তার স্ত্রী আলেকজান জানান, সরকার ঘর করে দিবে জেনে খুব খুশী হয়েছিলাম। মেম্বার ও প্রতিবেশী একজনের মাধ্যমে তারা তাদের নাম দিতে বলেছিলেন। জানানো হয়েছিল তাদের নাম তালিকায় ওঠানো হয়েছে। তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য তিন হাজার টাকাও নেয়া হয়। তার মেয়ে টাকাগুলি দেয়। কিন্তু তাদের নাম তালিকায় নেই।

পলিথিনের ঘরেই আছেন সুমি বেগমঃ
এদিকে পলিথিন দিয়ে তৈরি ঘরেই স্বামী সন্তান নিয়ে দিন কাটাতে হয় কাশেমের মোড় (বালুরঘাট) এলাকার সুমি বেগমের। মেম্বার তার নামে ঘর বরাদ্দের জন্য নাম দিয়েছিল। যারা খাতায় নাম লেখে তারা ২০০শ টাকাও নিয়ে যায়। কিন্তু তালিকায় নাম নেই। মেম্বারও বিস্মিত হয়েছেন তালিকায় সুমী বেগমের নাম না থাকায়।

বিধবা কাজলীর নেই, স্বাবলম্বীদের ঘরঃ
বিধবা কাজলীও টাকা দিয়েছিল তালিকার জন্য। কিন্তু তাদের কারও নাম নেই তালিকায়। অথচ যাদের ঘর আছে, যারা স্বাবলম্বি তাদের কেউ কেউ ঘর পাচ্ছেন। হত দরিদ্রদের অনেকেই বঞ্ছিত হয়েছেন।

নিম্ন উপকরণের অভিযোগ আ’লীগ নেতাদেরঃ
স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহম্মদ শাজাহান সহ এলাকার অনেকেই অভিযোগ করেন, প্রশাসনের তদারকিতে যে সব ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে তা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বেশী খরচ হবেনা। পিলার ও কাঠ নিন্মমানের। হতদরিদ্র মানুষের ঘর তৈরির নামে চলছে অর্থ হরিলুট। তারা অভিযোগ করেন উপজেলার সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি এর সাথে জড়িত।

ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার নামে বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগ হরিলুট করে সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করা হচ্ছে-। সুবিধাভোগীদেরও কেউ কেউ এমন অভিযোগ তুলেছেন।

সুবিধাভোগীদের বক্তব্যঃ
সুবিধাভোগীদের একজন জুনায়েদ আহমেদ বলেন, একটি ঘরের জন্য যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার অর্ধেকও ব্যয় করা হচ্ছেনা। তারা জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানান।

জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যঃ
লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের দুই ইউপি সদস্য গোলাম মোস্তফা ও আব্দুল মান্নান বলেন তালিকা করতে টাকা নেওয়ার কথা এলাকায় আলোচিত হচ্ছে। তবে কেউ টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করতে চায়না।

তবে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের সনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ যারা পাওয়ার যোগ্য তাদের নাম তালিকাভুক্ত করার দাবীও জানান এবং প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প তালিকার এই কার্যক্রমে সুবিধাভোগীরা যেন বঞ্চিত না হয় এমনটাই প্রত্যাশা করেন তারা।

ইউএনও’র দাবী অভিযোগ ভিত্তিহীনঃ
নাটোর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমিন আক্তার বানু ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবী করে বলেন, ঘর নির্মাণ কাজ শেষ না হতেই এমন অভিযোগ সঠিক নয়। ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের দেওয়া সুপারিশ অনুযায়ী তালিকা করা হয়েছে। তবে অর্থ নেওয়ার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *