নাটোরে সুমাইয়া হত্যার আসামীদের যেভাবে ধরলো পুলিশ

নাটোর অফিস॥শ্বশুরবাড়িতে গত ২২ জুন অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুনের। মাসহ স্বজনরা ছুটে এসে হাসপাতালে তার মরদেহ পেলেও শ্বশুরবাড়ির কেউ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তখনই সবাই পালিয়ে যান।

এ ঘটনায় সুমাইয়ার মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে দাবি করে তার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ননদের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন মা নুজহাত সুলতানা। প্রশাসনের সদিচ্ছায় মাত্র তিনদিনেই এ মামলার সব আসামি ধরা পড়েছে। তবে কী কৌশল অবলম্বন করলো পুলিশ যাতে তিনদিনেই ধরা পড়লো সব আসামি? এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে বর্নিত রয়েছে সবকিছুর আদ্যোপান্ত।

মূলত, নাটোর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) লিটন কুমার সাহার তাৎক্ষণিক নির্দেশ ও পদক্ষেপের কারণেই আসামিরা পালানোর আগেই ধরা পড়ে গেছে পুলিশের জালে। আর জাল বিছানোর কাজসহ পুরো অভিযানটিই সার্বক্ষণিক মনিটরিং করেন এসপি লিটন।

লিটন কুমার সাহা বলেন, ‘মামলা দায়েরের পর আসামিদের ধরতে সুচিন্তিত পরিকল্পনা করে মাঠে নামে জেলা পুলিশ টিম নাটোর। মামলা দায়েরের পরদিন মঙ্গলবার (২৩ জুন) বিকেলে হরিশপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় নিহত সুমাইয়ার শাশুড়ি সৈয়দা মালেকা আক্তার ও ননদ জাকিয়া ইয়াসমিন যুথিকে। ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেন সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত ও সদর থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি জাহাঙ্গীর আলম জানান, এসপি স্যারের নির্দেশ মতো ওই অভিযানে অংশ নেয় ৪ টি টিম। অভিযানের আগে ওই এলাকায় গোপনে খোঁজ নেওয়া হয়। খুঁজে বের করা হয় কাদের সঙ্গে আসামিদের আত্মীয়তা রয়েছে, কারা তাদের লুকিয়ে রাখতে পারে এসব বিষয়। এরপর সম্ভাব্য ৪টি স্থানে একযোগে অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে পাশাপাশি দুটি বাড়ি থেকে ওই দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়।

এসপি লিটন কুমার সাহা জানান, ‘আসামিরা কোথায় কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে সেজন্য সম্ভাব্য এলাকা নির্ধারণ করতে তাদের আত্মীয়দের বিষয়ে গোপনে সন্ধান করা হয়। এতে বগুড়া, রাজশাহী, সিংড়া ও বাঘাসহ মোট ৮টি স্থানকে আমি চিহ্নিত করি। এরপর দুইজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সিংড়া ও সদর থানার ওসি, ডিবি ওসি, সদর থানার ওসি (তদন্ত), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হেড কোয়ার্টার), এবং ডিবি এসআই মিঠুনের নেতৃত্বে আটটি টিম সাজানো হয়। মোট ৫৬ জন পুলিশ সদস্যকে এই ৮ টি টিমে সংযুক্ত করা হয়।’

পুরো অভিযান নিজে মনিটরিং করেছেন জানিয়ে এসপি বলেন, বুধবার (২৪ জুন) দিনেই নির্ধারিত এলাকায় গোপনে অবস্থান নেয় জেলা পুলিশ টিমের সকল সদস্য। সারারাত নজরদারি শেষে বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) ভোর চারটায় একযোগে ওই আটটি স্থানে যুগপৎ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে নন্দীগ্রাম থেকে মোস্তাক ও বাঘা থেকে জাকিরকে পাওয়া যায়। তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হয়।’

এসপি লিটন কুমার সাহা আরও জানান,নন্দীগ্রাম টিমে নেতৃত্ব দিয়েছেন সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত আর বাঘায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সদর ওসি জাহাঙ্গীর আলম ও ডিএসবি।

এত স্বল্প সময়ে সকল আসামি গ্রেফতার হওয়ায় জেলা পুলিশের দক্ষতা, পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তায় খুশি এলাকাবাসী। সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত সুমাইয়ার পরিবার সদস্যরাও।

নিহত সুমাইয়ার চাচা মোমিন জানান, এত অল্প সময়ে সকল আসামি গ্রেফতার হওয়ায় তারা সবাই খুশি হয়েছেন। এজন্য তারা পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।

উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে মাস্টার্সে প্রথম বিভাগ অর্জনকারী মেধাবী শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুন তার শ্বশুরবাড়িতে গত ২২ জুন মারা যান। তার স্বামী, শাশুড়ি, শ্বশুর ও ননদের বিরুদ্ধে তাকে হত্যা করে লাশ হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন সুমাইয়ার মা নুজহাত সুলতানা। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার এজাহারও দায়ের করেন তিনি। সুমাইয়া সদর উপজেলার বলারীপাড়া মহল্লার মৃত সিদ্দিকুর রহমানের মেয়ে। সুমাইয়ার পরিবারের দাবি, চাকরি করে স্বাবলম্বী হতে চাওয়ায় প্রথমে নুজহাতের গর্ভের সন্তান নষ্ট করে তার স্বামী। এরপর বাবার বাড়ি থেকে কৌশলে ডেকে নিয়ে সুমাইয়াকে হত্যা করা হয়।

এদিকে হত্যা মামলার মূল আসামি নিহতের স্বামী মোস্তাক হোসাইনকে বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম ও নিহতের শ্বশুর জাকির হোসেনকে রাজশাহীর বাঘা এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করে জেলা পুলিশ।

অপরদিকে, আজ শুক্রবার(২৬শে জুন) বিকালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নাটোর থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত আব্দুল মতিন আসামিদেরকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদি হাসানের আদালতে হাজির করে ৭দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায়। উভয় পক্ষের শুনানী শেষে বিচারক ৩দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এই হত্যারহস্য উন্মোচন ও আসামীদের গ্রেফতার নাটোর জেলা পুলিশের অর্জনের ঝুলিতে বড় সাফল্য যোগ করলো।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *