নাটোরে ‘আত্ননির্ভরতার স্বপ্ন’ কেড়ে নিলো ঢাবি শিক্ষার্থীর জীবন

নাটোর অফিসঃ আর দশজনের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে জীবন গড়ার তাগিদ থেকেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন নাটোরের সুমাইয়া বেগম। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে আত্ননির্ভরতা অর্জনের যে তাগিদ ছিলো তার মাঝে, শেষ পর্যন্ত তা-ই কাল হয়ে দাঁড়ালো তার জীবনে।

গতকাল সোমবার নাটোর শহরতলীর হরিশপুর এলাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী সুমাইয়ার।

উচ্চশিক্ষিত সুমাইয়া আরেকটু মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ থেকে প্রস্ততি নিচ্ছিলেন বিসিএস পরীক্ষার। সুমাইয়া গৃহবধু হয়েও পড়াশুনা চালিয়ে যাক, তা চাইতো না শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

সুমাইয়ার বাবা বেঁচে নেই। আছে মা নুজহাত বেগম ও ভাই সালাহ উদ্দীন।

সোমবার শ্বশুরবাড়ী থেকে সুমাইয়ার মৃতদেহ উদ্ধারের পর ওই বাড়ির লোকজন ‘জোর প্রচার’ শুরু করেন সুমাইয়া ‘আত্নহত্যা’ করেছে। এই প্রচারের জোরেই সারাদিন অতিবাহিত হয় থানায় কোনরুপ অভিযোগ ছাড়াই। পুলিশ তাই অপমৃত্যু হিসেবেই এই ঘটনার রেকর্ড রাখে।

সাবেক এই শিক্ষার্থীর রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পেরে তৎপরতা শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ছাত্র সংসদের(ডাকসু) সাবেক এজিএস ও ইউনিট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন।
এ ঘটনার সুস্থ তদন্ত ও বিচার দাবীতে বিভিন্ন সূত্রে তৎপরতা শুরু করেন।

সাদ্দাম হোসেনের তৎপরতা সম্পর্কে ঢাবিস্থ নাটোর জেলা ছাত্র কল্যান সমিতির সহ-সম্পাদক ইব্রাহীম খলিল নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, “সোমবার থেকেই এ ঘটনার ব্যাপারে জানতে চান ডাকসু এজিএস সাদ্দাম হোসেন। তিনি পুরো ঘটনা শুনে একাত্নতা পোষণ করেন এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিতে পাশে সুমাইয়ার পরিবারের থাকার আশ্বাস দেন।”

দেশের অন্যতম সংবাদভিত্তিক বেসরকারি চ্যানেল সময় সংবাদ জানাচ্ছে, সোমবার সকালে স্বামীর বাড়ি থেকে মৃত অবস্থায় নাটোর সদর হাসপাতালে আনা হয় সুমাইয়াকে। এরপর সুমাইয়া গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করা হয় মোস্তাকের পরিবার থেকে। তবে গতকাল সন্ধ্যায় সুমাইয়ার মা নুজহাত এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ করেন। এ ঘটনা সময় সংবাদের ওয়েবে প্রচার হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন।

সময় সংবাদে বলা হয়েছে ‘তাদের ওয়েবে প্রচার হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।’

খবরে জানানো হয়, সোমবার (২২ জুন) মধ্যরাতে সুমাইয়ার মা নুজহাত হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রথমে এ মৃত্যুর ঘটনায় সুমাইয়ার বাবার বাড়ির কেউ অভিযোগ না করায় পুলিশ ইউডি মামলা করে, পাশাপাশি রাতেই একজনকে গ্রেফতার করে তারা।
মঙ্গলবার (২৩ জুন) সকালে এ ঘটনায়র পর সুমাইয়ার চাচা মোহাম্মদ আলী জানান, রাত ১টার দিকে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাড়িতে এসে মামলা করার কথা বলেন। পরে সুমাইয়ার মা নুজহাত ৪ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেন।’

জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল বিয়ে হয় হরিশপুর এলাকার মোস্তাকের সঙ্গে সুমাইয়ার। এরপর বেশ কয়েকবার তাকে টাকা দেয়া হয়। এমনকি বাড়ির আসবাবপত্র সব কিছু সুমাইয়ার বাবা কিনে দেন মেয়ের সংসারে। গত ৮ মাস আগে সুমাইয়ার বাবা সিদ্দিকুর রহমান মারা যান। তার মৃত্যুর পরও জামাতা মোস্তাক আবার টাকা চান। এ বিষয়ে মেয়ে তাকে কিছু না বলে বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। নিজেই আয় করে স্বামীর পরিবারকে সহযোগিতা করবে এমনটা চিন্তা করে সে। কিন্তু এটা মেনে নিতে পারেনি তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। তাই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।

সুমাইয়ার মা নুজহাত বেগম ও  ভাই সালাহ উদ্দিন জানিয়েছেন, সুমাইয়াকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়েছে। পরবর্তীতে সন্ধ্যার দিকে তারা নিশ্চিত হন এটা হত্যা।

নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, “প্রথমে এই ঘটনায় সুমাইয়ার পরিবার থেকে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তাই নিয়মানুযায়ী পুলিশের পক্ষ থেকে অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে সুমাইয়ার পরিবার থেকে হত্যার অভিযোগ করা হয়। তাই হত্যা মামলা নেয়া হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত শ্বাশুরি সৈয়দা মালেকা ও নন জাকিয়া জুথিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় ছাত্র সংসদের(ডাকসু) সাবেক এজিএস ও ইউনিট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন মঙ্গলবার রাতে এক সাক্ষাতকারে জাগোনাটোর২৪.কমকে বলেছেন,”আত্ননির্ভরতার যৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুমাইয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজন জীবদ্দশায় তাকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছি। আশা করছি পুলিশ এ ঘটনায় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করবেন। অন্যথায় আমরা বিচারের দাবীতে সোচ্চার হবো।”

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারীর আত্ননির্ভরতা অর্জন যখন খুবই প্রয়োজন, তখন এই ধরণের ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি বা দোষীদের রেহাই দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া অপরাধটি উৎসাহিত করার শামিল। এক্ষেত্রে অভিযোগকারীকেও তার অবস্থাঅবস্থানে তার অবস্থানে দৃঢ় থাকতে হবে। তা না হলে অনেক সুমাইয়া হবে এরুপ ঘটনার শিকার- এমনটাই মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *