নাটোরের চামড়া ‘চীনে রপ্তানিতে’ সহায়তা আহ্বান ব্যবসায়ীদের

নাইমুর রহমান,নাটোর॥
বাংলাদেশের ৫১৬১টি পণ্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানী সুবিধা পাওয়ায় দেশের অন্যতম রপ্তানী পণ্য চামড়া নিয়ে নতুন করে ভাবছেন ব্যবসায়ীরা। বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়া শিল্পে ক্রমাগত লোকসানে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন অনেক মৌসুমী ও মাঝারি ব্যবসায়ী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত অবস্থায় ঢাকার ট্যানারীগুলোতে পড়ে আছে বছরের পর বছর। চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধাকে স্থবির এই শিল্প খাত চাঙ্গা করার সুযোগ হিসেবে মনে করছেন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার মোকাম নাটোরের চকবৈদ্যনাথের চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়ৎদাররা।

চামড়া খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের শতকরা ৬০ ভাগের বেশী রপ্তানী হতো চীনে। কয়েক দশক আগে দেশে বিপুল পরিমাণে চামড়ার একচেটিয়ে ক্রেতা ছিলো চীন। তুলনামূলক মানসম্পন্ন ও দামে কম হওয়ায় ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে বাজরেই ব্যবসা করতেন চীনের ক্রেতারা। তবে এক্ষেত্রে দামের ব্যাপারে চীনের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েন দেশের ব্যবসায়ীরা। দেশী চামড়ায় তৈরী বিভিন্ন পণ্যে চীন বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান নিলে ইউরোপের দেশগুলো বিভিন্ন শর্তে বিভিন্ন দামে বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা শুরু করে। এতে শুরুর দিকে ভালোদামে চামড়া বিক্রি শুরু করলেও নানা রকম শর্ত আরোপ করতে শুরু করে তারা। এসময় বাংলাদেশের চামড়ার বাজার আবারো চলে যায় ভারতের কাছে। বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনতে পরিবেশগত, সামাজিক ও শ্রমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানদন্ড অনুসরণের শর্তারোপ করে হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরে বাধ্য করে ইউরোপের দেশগুলো। নানা কারণে সেই শর্ত পুরণ না হওয়ায় দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণসহ বিভিন্ন যৌক্তিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় পিছিয়ে পড়ে দেশের চামড়া বাজার। এর উপর করোনা পরিস্থিতিতে গত চার মাস ধরে প্রায় বন্ধ বিশ্ববাজারে চামড়া রপ্তানী। এমন পরিস্থিতিতে করোনার ধকল কাটিয়ে দেশের ৯৭ ভাগ পন্য বিনাশুল্কে রপ্তানীর সুযোগ দেয়ায় আবারো চামড়া শিল্পের সুদিন ফিরবে।

চকবৈদ্যনাথ মোকামের ব্যবসায়ী ও আড়ৎদাররা মনে করেন, বিশ্ববাজারে দেশের চামড়ার বাজার প্রতিষ্ঠিত বাজার। রপ্তানীর এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রথমেই চামড়া শিল্পটিকে সচলের উদ্যোগ নেয়া। দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শুল্কমুক্ত রপ্তানীর সুযোগ পেলে ফড়িয়া, মৌসুমি ব্যবসায়ী, সাধারণ ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ট্যানাররা সকলেই লাভবান হবে। দীর্ঘদিন আটকে থাকা কোটি টাকার পুঁজিও ফিরে পাবে ব্যবসায়ীরা। গক কয়েক বছরে ক্রমাগত লোকসান কাটিয়ে উঠে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে চামড়া খাতটি।

নাহিদ এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী নুরুল ইসলাম বলেন, “বৈশ্বিক মহামারী করোনার মধ্যে বাংলাদেশকে চীনের শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানী সুবিধা প্রদান একটি সুসংবাদ। সরকারের কুটনৈতিক প্রচেষ্টার এই ফলাফলের জন্য আমরা ব্যবসায়ীরা কৃতজ্ঞ। চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে হলে রপ্তানীর তালিকায় প্রথমে রাখতে হবে চামড়াকে।”

চামড়া ব্যবসায়ী হালিম সিদ্দিকী বলেন, “চীনে দেশী চামড়ার বাজার আবারো চালু হয়ে রপ্তানী আয় বাড়বে। যেহেতু অতীতে বাংলাদেশী চামড়া যথেষ্ট সুনামের সাথে চীনে ব্যবসা করেছে, তাই খাতটি আশানুরুপ সাড়া পাবে। শুল্ক মওকুফ হওয়ায় চামড়ার ভালো দাম পাওয়া যাবে।”

চামড়া ব্যবসায়ী মুঞ্জুরুল ইসলাম হিরু বলেন, “কয়েক বছরে চামড়ার বাজারের লোকসান অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এই অবস্থায় শিল্পটির জন্য আলাদা ভাবনা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। সরকার বিশেষ কুটনৈতিক তৎপরতায় শুল্কমুক্ত রপ্তানীর যে সুবিধা এনেছে, তা কাজে লাগানোর জন্য এই মুহুর্তে সবচেয়ে উপযুক্ত খাত চামড়া শিল্প।”

জেলা চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সহ-সভাপতি আলহাজ্ব লুৎফর রহমান বলেন, “চামড়া রপ্তানীর ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক হলে আগামীতে বিপুল পরিমাণ চামড়া চীনে রপ্তানী সম্ভব। যেহেতু নাটোরের চামড়া গুণগত দিক থেকে অনেক ভালো, সেহেতু এই বাজার রপ্তানী বাণিজ্যে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাভারে চামড়া শিল্পনগরীরে পরিবেশবান্ধব ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করলে ট্যানাররা ব্যাংক ঋণের সুযোগ পাবেন। নিজস্ব পুঁজি ও ঋণ দ্বারা আগামী কোরবানী মৌসুম থেকেই শুরু হতে পারে চীনে রপ্তানীর উদ্দেশ্যে চামড়া কেনাবেচা। এজন্য আমরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের(এফবিসিসিআই) পরিচালক ও নাটোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান বলেন, “বিনা শুল্কে আমরা চীনের বাজারে প্রবেশ করবো এটি নিঃসন্দেহে সুসংবাদ। এতোদিন বিপুল পরিমাণ শুল্ক পরিশোধ করে আমাদের চীনের বাজারে টিকে থাকতে হয়েছে। বিশ্ববাজারে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় চামড়া রপ্তানীর পাশাপাশি চামড়াজাত পণ্য রপ্তানীর দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে চীনের বাজার আমাদের জন্য বড় একটি সুযোগ। প্রতিবছর আমাদের নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য চামড়াজাত দ্রব্য আমদানী করতে হয়। তাই চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদনে মনোযোগী হলে রপ্তানীর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।”

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *