নাটোরে থেকেই শুরু হয় নব্য জেএমবির কিলিং মিশন

নাইমুর রহমান॥
হোলি আর্টিজেন রেস্তোরায় জঙ্গী হামলার ২৫ দিন আগে নব্য জেএমবি প্রথম কিলিং মিশন সম্পন্ন করেছিলো নাটোরে। ২০১৬ সালের ৫ই জুন দুপুরে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া খ্রিষ্টানপল্লির মুদি দোকানী সুনীল গোমেজ হত্যাকান্ডেরও মাধ্যমে শুরু হয় এই কিলিং মিশন। এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনায় ছিলেন হোলি আর্টিজেন রেস্তোরায় জঙ্গি হামলা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী জাহাঙ্গির আলম ওরফে রাজীব গান্ধী। হত্যাকান্ডের সময় নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের সামরিক কমান্ডার ছিলেন তিনি। তার পরিকল্পনায় মোট ৬জন অংশ গ্রহন করে। হামলার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন রাজীব গান্ধী। ওইদিন সন্ধ্যায় জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে।

সাংগঠনিক কাজের সুবিধার্থে ৬টি নাম ব্যবহার করতেন রাজীব গান্ধী। সেগুলো হচ্ছে, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজিব গান্ধী ওরফে সুবাস ওরফে টাইগার ওরফে শান্ত ওরফে আদিল। তবে রাজীব গান্ধী হিসেবে সংগঠনে মূল পরিচিতি পান তিনি।

এই হত্যাকান্ডের একদিন পর ৭ জুন ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী ও চারদিন পর ১০ই জুন পাবনায় ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সেবাশ্রমের এক সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডেকে একই কায়দায় হত্যা করে জঙ্গীরা। হামলার পর দায় স্বীকার করে বার্তা দিয়েছিলো
নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের সামরিক কমান্ডার থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালের ৩রা এপ্রিল গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার পুর্ণভুতপাড়া গ্রাম থেকে রাজীব গান্ধীকে গ্রেফতারের করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সুনীল গোমেজ হত্যাকান্ডের সাথে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করলে তাকে প্রথমে আনা হয় নাটোরে। এরপর নাটোর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক শামসুল আল আমিনের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাজীব গান্ধী।

ওই জবানবন্দীতে রাজীব গান্ধী বলেন, সুনীল গোমেজ হত্যাকান্ডের কয়েকদিন আগে নাটোর বঙ্গজ্জ্বল রাজবাড়ীতে সহযোগিদের নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। তার নেতৃত্বে ওই বৈঠক থেকে স্থানীয় তারেকশ্বর শীব মন্দিরের পুরোহিত গোবিন্দ হালদার, শহরের অদূরে হরিশপুরের খ্রিষ্টান সম্প্রদায় পরিচালিত ব্যাপিস্ট মিড মিশন হাসপাতালের একজন বিদেশী চিকিৎসক, খ্রিষ্টান মুদি ব্যবসায়ী সুনিল গমেজ এবং বনপাড়া খ্রিষ্টান পল্লীর আরেক ব্যবসায়ীকে টার্গেট করে জঙ্গীরা। হত্যাকান্ড শেষে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রথমেই বেছে নেয়া হয় বনপাড়া খ্রিষ্টান পল্লীর মুদি দোকানী সুনিল গোমেজকে।

তৎকালীন নাটোরের পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয় তালুকদার জানান, ওই কিলিং মিশনে অংশ গ্রহন করে মোট ৫জন নব্য জেএমবি সদস্য। এদের মধ্যে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন ছিলেন। হত্যাকান্ড সম্পন্ন করার পর মোটরসাইকেলটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাবনার দিকে। আর থ্রিমা নামের একটি অ্যাপস ব্যবহার করে যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতো তারা।

সুনীল গোমেজ হত্যাকান্ডের পরদিন তার মেয়ে স্বপ্না গোমেজ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে বড়াইগ্রাম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।

রাজীব গান্ধীর জবানবন্দীর সূত্র ধরে তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ১৫ই নভেম্বর হত্যাকান্ডে মোট ১২ জঙ্গির সম্পৃক্ততার বিষয়টি অন্তভূক্ত করে আদালতে চার্জশীট দেয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। অভিযুক্তদের মধ্যে ৭জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ও ৪ জন পলাতক ছিলেন। একমাত্র জীবিত ও উপস্থিত আসামী ছিলেন রাজীব গান্ধী।

সেই রাজীব গান্ধী আলোচিত হোলি আর্টিজেন জঙ্গী হামলা মামলায় ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত সুনীল গোমেজের স্ত্রী জোসিন্তা গোমেজ। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি উচ্চ আদালতেও রায় বহাল থাকার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।

বনপাড়া ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত ফাদার বিকাশ হিউবার্ট রিবেরু বলেন, রাজীব গান্ধীর মতোই মুদি দোকানী সুনীল গোমেজের হত্যাকান্ডে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করি। আমরা সব ধর্মের মানুষের সাথে মিলে মিশে বসবাস করি, আগামীতেও করতে চাই।

জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সভাপতি চিত্তরঞ্জন সাহা বলেন, আমরা রায়ে সন্তুষ্ট। আমরা বিশ্বাস করি উচ্চ আদালতে দৃস্টান্তমূলক এই রায় বহালের পর কার্যকরের মাধ্যমে জঙ্গীবাদী কর্মকান্ডে কেউ সাহস পাবে না।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *