নাটোরে প্রতারকের খপ্পরে সর্বশান্ত পাইলটের পরিবার

নাটোর অফিস॥
সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে ছেলে পাইলটকে সৌদি আরব পাঠাতে চেয়েছিলেন বাবা মোজাহার আলী। এজন্য সম্বল ১০ কাঠা জমি ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। নাতির বিদেশ যাওয়া নিশ্চিত করতে পাইলটের দাদী শাহিদা বেওয়াও তার শেষ সম্বল তিন শতক বিক্রি করেন। আদম বেপারীর চাহিদা অনুযায়ী সাড়ে সাত লাখ টাকা যোগাতে তার ছোট চাচা ময়েন উদ্দীনও নিজের অংশের জমি বিক্রি করে দেন এক লাখ টাকায়। আর মা বিজলী বেগম গহনা বিক্রি করে দেন আরো এক লাখ টাকায়। বাকী ৫০ হাজার টাকা যোগান দেন প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম।

গত ছয় মাস আগে এভাবেই একে একে শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে সৌদি আরব যাওয়ার জন্য এসব সমুদয় টাকা তুলে দেন সৌদি প্রবাসী প্রতিবেশী হাসান আলীর বাবা বিচ্ছেদ আলীর হাতে। ভিসাও পাঠানো হয় পাইলটের নামে। কিন্তু সেই ভিসাটা ছিল জাল। পরে আর সৌদি যাওয়া হয়নি তার। টাকাও ফেরত পায়নি পাইলট। টাকা ফেরত চাইলে উল্টো হুমকি ধামকি দেয়া হয় তাদের। এনিয়ে সালিশি বৈঠকেও সুরাহ হয়নি। ফলে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব জীবন যাপন করছে পাইলট ও তার পরিবার। শেষ পর্যন্ত তাদের সংসারের হাল ধরতে ঢাকার এক গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করছেন পাইলটের মা বিজলী বেগম। আর বাবা করছেন দিন মজুরী।এব্যাপারে থানায় লিখিত অভিযোগ করেও মিলছেনা প্রতিকার।

ঘটনাটি ঘটেছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাকা ইউনিয়নের তকিনগর গ্রামে।
শনিবার সরেজমিন এলাকায় গিয়ে এসব তথ্য জানান ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার সহ এলাকাবাসী। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ মোজাহার আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাইলটের বিদেশে যাবার খরচ যোগাতে বিক্রির জন্য কেটে রাখা একটি মেহগনি গাছ এখনও উঠানে পড়ে আছে। উঠান পেরিয়ে একটি খড়ের ছোট্ট ঘরে পাইলট, তার চাচা মিজানুর রহমান ও দাদী শাহিদা বেওয়া থাকেন। অপর একটি কুড়ে ঘরে থাকেন পাইলটের বাবা।

পাইলটের বাবা মোজাহার আলী জানান, প্রতিবেশী বিচ্ছেদ আলী ছেলে হাসান আলী সৌদি আরবে থাকায় তার ছেলে পাইলটকে সেখানে একটি হোটেল বয় হিসেবে চাকুরীর জন্য পাঠানোর প্রস্তাব দেন। এজন্য দাবী করা হয় সাড়ে সাত লাখ টাকা। এঅবস্থায় প্রথমে তাকে চার লাখ টাকা দেয়া হয়। পরে নানা অজুহাতে আরও সাড়ে ৩লাখ টাকা হাতিয়ে নেন বিচ্ছেদ আলী।

মোজাহার আলী আরও জানান, সৌদি আরব যাওয়ার আগে ছেলে পাইলটকে জামাকাপড়, একটি লাগেজ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দেন তিনি। সাড়ে ৭ লাখ টাকা জমা দেয়ার পর ভিসার কপি হাতে পেয়ে দেখা যায় সেটি জাল। ভিসার নম্বরের সাথে পাইলটের নাম ঠিকানা মিল ছিলনা। বিষয়টি বিচ্ছেদ আলীর নজরে আনলে তিনি প্রথমে ভুল স্বীকার করেন এবং নতুন করে ভিসার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। পরে দ্বিতীয় দফায় ভিসা ও মেডিক্যাল পরীক্ষার নামে চাওয়া হয় আরও দেড় লাখ টাকা। ওই দেড় লাখ টাকা না হলে সব প্রচেষ্টা শেষ হয়ে যাবে বলে জানায় বিচ্ছেদ আলী। পরে আবারও ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এরপর ভিসা দিতে গরিমসি করে বিচ্ছেদ আলী। এতে তার ওপর সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি বাহরাইন ফেরত প্রতিবেশী সাইফুল ইসলামকে জানানো হলে তিনি কাগজপত্র দেখে জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট করেন। এঘটনা জানাজানি হলে বিচ্ছেদ আলী ঘটনা ধামাচাপা দিলে আরেকটি ভিসা এনে দেন। দ্বিতীয় ভিসাটিও ভুয়া বা জাল বলে প্রমানিত হয় । এ নিয়ে এলাকায় একটি সালিশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সালিশে বিচ্ছেদ আলী ক্ষতিপুরন বাবদ আড়াই লাখ টাকা দিতে সম্মত হন। কিন্ত পরে ওই সিদ্ধান্ত অমান্য করেন। এনিয়ে আইনের আশ্রয় নিতে গেলে প্রাণণাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। এঘটনায় তিনি গত ৩০ অক্টোবর বিচ্ছেদ আলী (৫৫) ও তার তিন ছেলে হাসান আলী(২২), রাকিবুল ইসলাম(২৬) ও বিপ্লব হোসেনকে (২২) অভিযুক্ত করে বাগাতিপাড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ করার পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা। উপরুন্তু অভিযুক্তরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং হুমকি ধামকি দিচ্ছে।

পাইলট আলী অভিযোগ করে জানান, ‘তাকে মেডিক্যাল পরীক্ষার নামে ঢাকায় নিয়ে একটি হাসপাতালে সারাদিন বসিয়ে রাখেন বিচ্ছেদ আলী ও লোকজন। রাত হলে তারা জানান, তারা সব কিছু ম্যানেজ করে নিয়েছেন, পরীক্ষা না করলেও চলবে। সৌদি যাওয়া ফাইনাল।’ কিন্তু তাদের প্রতারনার কারনে সৌদি আরবে আর যাওয়া হলোনা।

প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম জানান, মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে যেতে হলে দুতাবাসের চাহিদা অনুসারে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। সে অনুযায়ী নির্ধারিত তিনটি হাসপাতালে পরীক্ষা করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এতে প্রতারনার বিষয়টি ধরা পরে।

এদিকে অশ্রুসজল চোখে পাইলটের দাদী শাহিদা বেওয়া বলেন, তার স্বামী মারা যাবার আগে তিন শতক জমি তার নামে দিয়ে যান। নাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে জমিটিও নামমাত্র দামে বিক্রি করে নাতিকে টাকা দিয়েছেন। নাতি বিদেশে তো যেতে পারলই না বরং তারাই আজ নিঃস্ব হলো।

অভিযুক্ত বিচ্ছেদ আলীর বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার বোন আসমা বেগম অভিযোগ অস্বীকার করে সাফ জানিয়ে দেন, তার ভাইয়ের সাথে পাইলটের পরিবারের কোন রকম লেনদেন হয়নি।

স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য আকরাম হোসেন জানান, তিনি দ্রুত পাইলটের পরিবারকে অর্থ ফেরত দিতে অনুরোধ করেছেন বিচ্ছেদ আলীকে। তবে বিচ্ছেদ এ নিয়ে কোন কর্ণপাত করেননি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বাগাতিপাড়া থানার উপ-পরিদর্শকক(এসআই) সাজ্জাদুর রহমান জানান, অভিযোগটি পাওয়ার পর দুপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। এ ব্যাপারে আগামী মঙ্গলবার উভয় পক্ষকে থানায় ডাকা হয়েছে। অবস্থা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *