নাটোরের ‘জাহালম’ চা বিক্রেতা বাবলু শেখ

নাটোর অফিস
নাটোরের দরিদ্র চা দোকানি বাবলু শেখ যেন আরেক জাহালম। টাঙ্গাইলের জাহালম যেমন ভুল আসামি হয়ে প্রায় তিন বছর জেল খেটেছেন, তেমনি ভুল আসামি হয়ে জেল খেটেছেন নাটোরের চা দোকানি বাবলু শেখও। ভুল আসামি হয়েও বাবলু শেখকে ৫৯ দিন কারাভোগসহ দীর্ঘ ১৮ বছর নানা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। অবশেষে দীর্ঘ ১৮ বছর পর তাকে মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে দায়ী তদন্তকারী দুই পুলিশ কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোমিনুল ইসলাম ও হেলেনা পরভীনসহ নাটোর সদর থানার তৎকালীন ওসির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাবলু শেখকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সাইফুর রহমান সিদ্দিকী মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে এই আদেশ দেন।

নাটোর জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম রায়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষে এপিপি মাসুদ হাসান ও আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট শামীম উদ্দীন মামলা পরিচালনা করেন।

মামলার নথি ও বাদীর আইনজীবী সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল নাটোর সদর উপজেলার গাঙ্গইল গ্রামে একটি মারামারির ঘটনার তিনদিন পর শ্রী বাবুসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে নাটোর সদর থানায় মামলা করেন জনৈক আবদুল মালেক। মামলায় সিংড়া উপজেলার আঁচলকোট গ্রামের শ্রী দেব দাসের ছেলে শ্রী বাবুকে ৩ নম্বর আসামি করা হয়। নাটোর সদর থানার তৎকালীন এসআই মমিনুল ইসলাম তদন্ত শেষে শ্রী বাবুকে অভিযুক্ত করে একই বছরের ১৫ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। পরে একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর পুনরায় শ্রী বাবুকে অভিযুক্ত করে সদর থানার এসআই হেলেনা পারভীন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

বাদীর আইনজীবী আরও জানান, মামলার এজাহারে উল্লেখিত আসামি বাবুকে গ্রেপ্তার না করে ২০০২ সালের ৭ নভেম্বর ইয়াকুব আলীর ছেলে বাবলু শেখকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ। এই ভুলের বিষয়টি আদালতকে অবহিত না করে ছয়দিন পর ১৩ নভেম্বর বাবু পরিচয়েই বাবলু শেখের জামিন করান তার তৎকালীন আইনজীবী লুৎফর রহমান বাবু। পরে ওই পরিচয়েই বাবলু শেখের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ ও আসামি পরীক্ষা করেন। যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৬ সালের ২৩ জুন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হাবিবুর রহমান আসামি বাবুকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। ওইদিনই কাঠগড়া থেকে বাবলু শেখকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট আপিলের মাধ্যমে জামিনে বের হন বাবলু শেখ। এ বিষয়ে নাটোর দায়রা জজ আদালতে আপিল করা হলে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সাইফুর রহমান সিদ্দিকীর আদালতে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠানো হয়।

বাবলু শেখের বর্তমান আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামীম উদ্দীন জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সাইফুর রহমান সিদ্দিকী মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে যে আদেশ দেন তাতে দীর্ঘ ১৮ বছর পর বাবলু শেখের ভোগান্তির অবসান ঘটলো।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১৫ এপ্রিল নাটোর সদর উপজেলার গাঙ্গইল গ্রামে একটি মারামারির মামলার আসামি শ্রী বাবুর পরিবর্তে সিংড়া উপজেলার আঁচলকোট গ্রামের বাবলু শেখকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। এরপর বাবলু শেখের তৎকালীন আইনজীবী লুৎফর রহমান বাবু মামলার প্রকৃত আসামি শ্রী বাবুর নামেই বাবলু শেখের জামিন করান। সে থেকে বাবলু শেখ হয়ে যান শ্রী বাবু। দু’দফায় দুইমাস কারাভোগের পর ১৮ বছর ধরে দরিদ্র চা দোকানি বাবলু শেখ নিজের সঠিক পরিচয় জানাতে ঘুরে ফেরেন আদালতের বারান্দায়। এ নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে বাবলু শেখের পাশে দাঁড়ায় আইনজীবী, জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষ। ১৮ বছর আদালতের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়ে অবশেষে মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় বাবলু শেখ এখন অনেক খুশি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *