নাটোরের ‘মুড়ি গ্রামে’ মুড়ি উৎপাদনে ভাটা! 

নাইমুর রহমান, মুুুুড়িগ্রাম ঘুরে
রাসায়নিকমুক্ত মুড়ির কারণেই নাটোরসহ আশেপাশের জেলাগুলোতে ‘মুড়ি গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত নাটোর সদরের দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের গোয়ালদিঘী, কৃষ্ণপুর, বাকশোর, নেপালদিঘী, তেগাছি, তালগাছি, ঢাকোপাড়াসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম। রোজা শুরুর কয়েকদিন আগে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত হাতে ভাজা মুড়ি তৈরীতে ব্যস্ত থাকে এসব গ্রামের আড়াই শতাধিক পরিবারের নারী-পুরুষরা। তবে এবার ঘূর্ণিঝড়জনিত বৃষ্টিপাতে ভাটা পড়েছে রমজান মাসে ইফতারের প্রধান এ অনুষঙ্গ তৈরীতে। এখানকার মুড়ি ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়।
এসব গ্রামের কৃষকরা আমন, বিনা-৭, হরি, ২৯, ১৬, ৫২ প্রভৃতি ধানের মুড়ি তৈরী করলেও গত দুই দিনের (৩রা ও ৪ঠা মে) আদ্র আবহাওয়ায় মুড়ি তৈরীর ধান ভিজে যাওয়ায় মুড়ি তৈরী করতে পারেনি কোন পরিবার। রাসায়নিকমুক্ত হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্বেও জেলার একমাত্র মুড়ির মোকাম নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশ্ববর্তী ডালসড়ক বায়তুন নূর মসজিদ হাটে সরবরাহ কমেছে মুড়ির।
রোববার সকালে এসব গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বাড়ির উঠানে শুকাতে দেয়া হয়েছে মুড়ি তৈরীর ধান। বছরের এ সময়টিতে বাড়িতে বাড়িতে ঝনঝন-শনশন মুড়ি ভাজার শব্দ শোনা যায়। মুড়ি প্রস্ততকারী নারীরা দম ফেলার সময় না পেলেও এবার কাটাচ্ছেন অলস সময়। মুড়ি বাজারজাতকরণে জড়িয়ে এখানকার পুরুষদেরও একই অবস্থা। দুদিনের বৃষ্টিতে ধান শুকাতে না পারায় রোববার সকালে রোদ উঠতে দেখে উঠানে শুকাতে দিয়েছেন ধান। আজ (৫ই মে) রোদে ধান শুকাতে পারলে রাত থেকেই পুরোদমে শুরু হবে মুড়ি ভাজা।
মুড়ি প্রস্ততকারীরা বলছেন, বাজারে প্যাকেটজাত মুড়ির দাপটে এমনিতেই কোণঠাসা থাকে দেশী মুড়ি। তার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশী মুড়ি সরবরাহ বিঘিœত হওয়ায় খুব একটা লাভের আশা ক্ষীণ এবার। তব্ওু ধান কেনার খরচ উঠানোর জন্য হলেও বাধ্য হয়ে তাদের মুড়ি তৈরী করতে হবে।
গোয়ালদিঘী গ্রামের হাসিনা বেগম, নেপালদিঘীর ছবিরণ বেওয়া ও ঢাকোপাড়ার রওশন আরা জানান, দুদিনের বৃষ্টিপাতে ভিজেছে ধান। না শুকানোয় ভাজা যায়নি মুড়ি। সকাল থেকে রোদ উঠায় ধান শুকিয়ে সন্ধ্যার পর মুড়ি ভাজতে শুরু করা হবে বলে জানান তারা।
তেগাছির নুরুন্নাহার বেওয়া বলেন, এমনিতেই হাতে ভাজা মুড়ির বাজার সংকুচিত হচ্ছে। তার উপর দুদিন মুড়ি তৈরী করতে না পারায় লোকসান গুনতে হবে।
মুড়ি প্রস্ততকারী শহিদুল ইসলাম সারাবছরই মুড়ি তৈরী করেন। তিনি জানান, রোজা এলে চাহিদা বাড়ায় উৎপাদনও বাড়াতে হয়। প্যাকেটজাত মুড়ির তুলনায় বিক্রি কম হওয়ায় হাতে তৈরী মুড়ি কদর হারাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
কৃষ্ণপুর গ্রামের মানিক মিয়ার নিকট ৩৭ মণ বিনা-৭ জাতের ধান বিক্রি করেছিলেন দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের পূর্ব হাগুড়িয়া গ্রামের আব্দুল জলিল। তিনি জানান, মুড়ি বিক্রি অনিশ্চিত হওয়ায় এখন তার পুঁজি আটকে আছে। বৃষ্টিপাতের কারণে ধান শুকানোর সমস্যার কারণে এখনও তার বহু ধান অবিক্রিত অবস্থায় গোলায় পড়ে আছে।
তৈরী মুড়ি প্রস্ততকারীদের নিকট থেকে কিনে একমাত্র হাট বায়তুন নূর জামে মসজিদ হাটে  বিক্রি করেন ব্যবসায়ী আবুল হোসেন ও আব্দুল জলিল। তারা হাতে প্রস্তুত মুড়ির কেনাবেচার পরিধি বাড়াতে সরকারের নিকট স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তার দাবী জানান।
হাটের আড়তদার মিলন হোসেন বলেন, প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২৫০ মণ হাতে ভাজা মুড়ি মুড়ি হাটে বিক্রি হলেও গত দুইদিনে সরবরাহ কমেছে। সরবরাহের ঘাটতিতে বাজারে ঢুকে গেছে প্যাকেটজাত মুড়ি। আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে অবস্থার দ্রুত উত্তোরণ ঘটবে।
উল্লেখ্য, রোজা শুরুর দুইদিন আগে এ আড়তে হাতে তৈরী আমন ধানের মুড়ি মণপ্রতি ২৫০০ থেকে ২৭০০ টাকায় এবং ইরি ধানের মুড়ি ২০০০ থেকে ২৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর বাজারগুলোতে ইরি ধানের মুড়ি কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা ও আমন ধানের মুড়ি ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *