নাটোরে টাকা দিয়েও ভিজিডি কার্ডের অনিশ্চয়তায় দুঃস্থ নারীরা

নাটোর অফিসঃ নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নে দুঃস্থ মহিলা উন্নয়ন কর্মসূচী সহায়তা হিসেবে ভিজিডি কার্ড প্রদানে অর্থ আদায়সহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা,স্কুল শিক্ষক ও ইউপি চেয়ারম্যান- মেম্বারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। টাকা দিয়েও তালিকায় নাম নেই অনেকের। অর্থের বিনিময়ে স্বচ্ছলদের তালিকাভুক্ত করাসহ প্রকৃত দুঃস্থদের নাম অনলাইনে অন্তর্ভুক্তিকালে ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য না দিয়ে আবেদন বাতিলের ঘটনায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে এলাকাবাসী। অনিয়মের সাথে জড়িতদের তথ্য চেয়ে এরই মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডে মাইকিং করছেন এলাকার সচেতন মহল।

ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ভিজিডি কার্ড বাবদ সদর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মল্লিকপুর, খন্দকার মালঞ্চী, ক্ষীদ্র মালঞ্চী, বিল গোপালহাটি, কাজিরচক মালঞ্চী, জিগরী, কুঁঠিবাঁশবাড়িয়া, মশুরীয়া ও নূরপূর মালঞ্চী এলাকার ২০ জন ভুক্তভোগীর নিকট থেকে তোলা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। টাকাগুলো তুলেছেন ভিজিডি যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য বাগাতিপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কায়সার ওয়াদুদ বাবর, সদর ইউপির ৫নং ওয়ার্ড সদস্য আবুল কালাম, ৭ নং ওয়ার্ড সদস্য আজগর আলী, সংরক্ষিত সদস্য রুলিয়া বেগম ও আমেনা বেগম। এছাড়া যাচাই-বাছাই কমিটিও গঠনেও বিধামালা লঙ্ঘন করা হয়েছে। কমিটিতে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে একজন শিক্ষিকাকে রাখার নিয়ম থাকলেও রাখা হয়েছে একজন শিক্ষককে। একজন মুক্তিযোদ্ধা, পরিবার পরিকল্পনার ওয়ার্ডকর্মী, দুইজন করে গণ্যমান্য ব্যক্তির নাম কমিটিতে রাখা হলেও তাদের কোন মতামত গ্রহন করা হয়নি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার যোগসাজশে ইউপি চেয়ারম্যানের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান তার পছন্দের ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত করার জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। বিধি অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ে সহায়তা পেতে মোট বরাদ্দের দ্বিগুণ আবেদর্নে নির্দেশনা থাকলেও আবেদন নেয়া হয়েছে প্রায় তিনগুণ। ওই ইউনিয়ন থেকে আবেদন নেয়া হয়েছে ৮৯১টি। প্রতিটি আবেদনকারীর নিকট থেকে ১৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা করে মোট ৮০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে শুধু ৪ নং ওয়ার্ডেই। টাকাগুলো তুলেছেন ভিজিডি যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য বাগাতিপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কায়সার ওয়াদুদ বাবর, সদর ইউপির ৫নং ওয়ার্ড সদস্য আবুল কালাম, ৭ নও ওয়ার্ড সদস্য আজগর আলী, সংরক্ষিত সদস্য রুলিয়া বেগম ও আমেনা বেগম। এছাড়া যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনেও বিধামালা লঙ্ঘন করা হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা, পরিবার পরিকল্পনার ওয়ার্ডকর্মী, দুইজন করে গণ্যমান্য ব্যক্তির নাম কমিটিতে রাখা হলেও তাদের কোন মতামত গ্রহন করা হয়নি। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হাবীবা পারভীনের সহযোগীতায় ইউপি চেয়ারম্যান মজিবর রহমানের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। ওই ৪ নং ওয়ার্ডে মোট আবেদন নেয়া হয়েছে ১০৯টি। অথচ ৯টি ওয়ার্ডে গড় বরাদ্দের হিসেবে একটি ওয়ার্ডে আবেদন নেয়ার কথা ছিল ৬৪টি।

ভুক্তভোগীদের দাবী, বিধামালা অনুযায়ী গড় আবেদনের অর্ধেক অর্থ্যাৎ ৩৪ জন আবেদনকারী সহায়তার জন্য নির্বাচিত হলেও ইউপি চেয়ারম্যান ২৫ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। অবশিষ্ট ৯ জনকে চেয়ারম্যান পছন্দ অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ছক কষে রেখেছেন।

মল্লিকপুর গ্রামের জেবুন্নাহার বলেন, ভিজিডি কার্ডের তালিকা করার জন্য তিনি বাবর মাষ্টারকে ৮ হাজার টাকা দিয়েছেন। বিল গোপালহাটি গ্রামের নুরজাহান বেগম ইউপি সদস্য কালামকে ৫ হাজার টাকা, কুঠি বাঁশ বাড়িয়া গ্রামের রুমী বেগম মহিলা মেম্বার রুরিয়া বেগমকে ৩হাজার ৫শ টাকা এবং মশুড়িয়া গ্রামের মিতু বেগম মহিলা মেম¦ার আমেনা বেগমকে ১৫শ টাকা দিয়েছেন ভিজিডি কার্ডের জন্য। কিন্তু তাদের নাম তালিকায় ওঠেনি।

শিক্ষক বাবার আলী অর্থ নেয়ার অভিযোগ শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, একটি চক্র সুনাম ক্ষন্ন করতে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করে মিথ্যাচার করছেন।

স্থানীয় সমাজকর্মী আফরোজ্জামান নিপুন বলেন, ৪নং ওয়ার্ডের প্রায় ৩০ জনের কাছে থেকে ভিজিডি কার্ড দেয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন জনপ্রতিনিধিসহ কমিটির সদস্যরা। এ পর্যন্ত ২০ জনের তালিকা পাওয়া গেছে। প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই আবেদনকারীদের কাছে থেকে টাকা নেয়া হয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হলে স্থানীয়দের চাপের মুখে অনেকের টাকা গোপনে ফেরত দেয়া হচ্ছে।

এদিকে ৩নং ওয়ার্ডের ভুক্তভোগী দুঃস্থরা জানান, তাদের ওয়ার্ডে আবেদন পড়েছে ১০৪টি যেখানে নির্বাচিত হবেন ৩৪ জন। তালিকায় কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে পাশ্ববর্তী ইউনিয়নের ১০ জনের নাম। এতে নির্ধারিত ৩৪ জনের মধ্যে তাদের বাতিল করে তালিকার ২৪ জন ও বাদ পড়া ১০ জনের জায়গায় পছন্দের নামগুলো বসানো হবে। আবেদনের আগে প্রয়োজনীয় তথ্য নেয়ার পরও আবেদনকালে ৩০ জন নারীর পিতার নাম বাদ রেখেই আবেদন সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে যাচাইয়ের সময় চুড়ান্ত ভাবে ওই ৩০ জনের বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের স্থলে অর্থের বিনিময়ে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের আবেদনের ওই শূন্যপদ পছন্দের লোকেদর দ্বারা পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া একই মহিলার নাম একাধিকবার অন্তভুক্ত করা হয়েছে।

৪ নং ওয়ার্ডের ভুক্তভোগীদেরও একই অভিযোগ। তারা জানান, ওই ওয়ার্ডে আবেদন করেছেন ১০৯ জন। ৬৪ জনের একটি তালিকায় ৭ জনের নাম রয়েছে পাশ্ববর্তী ইউনিয়নের। তাদের আশংকা, ৩২ জনের তালিকায় প্রথমে ওই ৭ জনকে প্রথমে নির্বাচিত করে পরে বাতিল করা হবে। শূন্য ৭জনের স্থলে পছন্দের ৭ জনকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ভিজিডি সহায়তার জন্য দুঃস্থ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের ব্যাপক অনিয়মের সত্যতা যাচাইয়ে স¤প্রতি ৪ নং কুঁঠিবাঁশবাড়িয়া এলাকায় রেবেকা বেগম নামে একজন নারীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আবেদনে তার বাড়িটি মাটির তৈরী বলে তথ্য দেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটি একটি পাকা বাড়ি। এছাড়া পেশা হিসেবে দিনমজুরী উল্লেখ করা হলেও এর কোন সত্যতা মেলেনি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, শুধু চলতি অর্থবছরেই নয়, বিগত বছরেও এই ইউনিয়নে ভিজিডির জন্য চুড়ান্ত নির্বাচিত ৩০০ জনের নিকট থেকে খরচ বাবদ ৩০০ টাকা করে ৯০ হাজার টাকা আদায় করেছে ইউনিয়নের কয়েকজন কর্মকর্তা। আর আবেদনকালে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্যও নেয়া হয়েছে প্রায় লক্ষাধিক টাকা। এ কাজের জন্য দুলাল হোসেন নামে একজন চৌকিদারকে ইউপি সচিব আবেদ আলীর সহকারী নিযুক্ত করে তার পাশে বসিয়েই আদায় করা হয় টাকাগুলো। তবে এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে দাবী করেছেন ইউপি সচিব আবেদ আলী। তিনি বলেন, এবারে ইউপি সদস্যদের বিরুদ্ধে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ মৌখিকভাবে শোনা গেলেও কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি।

ইতোমধ্যে ৪নং ওয়ার্ডের নয়টি পাড়ার ২০ জনের কাছে থেকে কার্ড প্রদানের নামে ৮০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ সম্বলিত একটি তালিকা প্রকাশ করা হলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এলাকাবাসী। তারা জড়িতদের তথ্য চেয়ে এলাকায় মাইকিং করে অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ টাকা ফেরতের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট আবেদন করেন।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হাবীবা পারভীন বলেন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। তিনি দুঃস্থ মহিলা উন্নয়ন কর্মসূচীর সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও কার্ডের তালিকা তৈরি বা কমিটির সদস্য নির্বাচিত করার দায়িত্ব তার নয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি শুধু মনিটরিং করছেন। ভিজিডি কার্ডের তালিকা করার নামে অর্থ নেয়ার বিষয়টি তদন্তের জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

বাগাতিপাড়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান মজিবর রহমান অনিয়মের অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবী করে বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদন নেওয়া হয়েছে। তাই অনিয়মের সুযোগ নেই। যাদের স্কোর বেশী থাকবে তাদের অগ্রাধিকার থাকবে এবং অনিয়মের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন তিনি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাসরিন বানু ভিজিডি কার্ড বিতরনের তালিকা প্রস্তুতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, একজন কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমানিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন তিনি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *