আ’লীগ নেতার নেয়া ঘুষের টাকা ফেরত দিলেন ইউএনও

নাটোর অফিস ॥
নাটোরের গুরুদাসপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়ার কথা বলে অসহায় ৭ নারীর কাছে থেকে এক নেয়া ঘুষের টাকা ফেরত দিয়ে আওয়ামীলীগ নেতাকে রক্ষা করলেন ইউএনও (উপজেলা নির্বাহীূ অফিসার ) শ্রাবণী রায়। শুক্রবার ছুটির দিনের ইউএনওর বাড়িতে ডেকে এসব টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ওই ৭ নারীর মধ্যে ৫ জনের টাকা ফেরত দেয়া হলেও দুই জনের টাকা দেয়া হয়নি। তাদের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে অভিযুক্ত উপজেলা আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। মামলা প্রত্যাহার হলেই তাদের টাকা ফেরত দেয়া হবে। ভুক্তভোগী ৭ নারী হলেন নাজিরপুর ইউনিয়নের লক্ষীপুর গ্রামের রেজাউল করিমের স্ত্রী আসমা বেগম, ছাইফুল হোসেনের স্ত্রী ইঞ্জিরা বেগম, মৃত-হাসমত আলীর স্ত্রী রাবিয়া বেগম, মৃত-আবেদ আলীর স্ত্রী রিজিয়া বেগম, মৃত-তারামিয়ার স্ত্রী হাবিয়া বেগম, আব্দুল হামিদের স্ত্রী সাহারা বানু ও ইয়াছিন আলীর মেয়ে বিউটি খাতুন।
স্বামী পরিত্যাক্তা নারী ইঞ্জিরা বেগম বলেন,‘তার স্বামী অসুস্থ্য। তিনি নিজেই কাজ করে সংসার চালান। নিজেদের কোন জায়গা জমি ছিলোনা। তাই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। ঘর দেওয়ার কথা বলে নেতা নজরুল আমার কাছ থেকে নগদ ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় এবং বাকি ১০ হাজার টাকা ঘর পাওয়ার পর দিতে বলে। দীর্ঘদিন হলেও টাকা দেওয়ার পরও ঘর পাইনি। আমার টাকা ফেরত চাই এবং তার বিচার দাবী করছি। এই অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে আওয়ামীলীগ নেতা নজরুল ইসলামকে জেলে যেতে হয়েছ্।ে এছাড়া দলীয় পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়। তবে কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর অদৃশ্য কারনে তাকে পুনরায় দলীয় পদে ফিরিয়ে নেয়া হয়। ক্ষমতাধর এই নেতা জেলে বসেই এ্ক পুলিশ অফিসারকে বদলি করার দম্ভ দেখিয়েছেন।
এদিকে ঘুষের টাকা ফেরত দেওয়ার খবরটি ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা ইউএনওর বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। তারা এবিষয়ে জানতে ইউএনও শ্রাবনী রায়ের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অপরদিকে স্থানীয় সাংবাদিকদের উপস্থিতির কারনে দুপুর ২টার দিকে ঘুষের টাকাসহ ইউএনওর বাসভবনের পেছনের প্রাচীরে মই বেধে সেখান দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় ভুক্তভোগী নারীদের। এসময় ভুক্তভোগী নারীদের ইউএনওর বাড়ির প্রাচীর টপকে বাহিরে বের হয়ে আসতে দেখা যায়। ঘুষের টাকা ফেরত নারীদের সাথে সাথে কথা হয় সংবাদকর্মীদের। তারা বলেন, ইউএনও শ্রাবনী রায় বৃহষ্পতিবার রাতে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের শুক্রবার সকালে তার সরকারি বাসভবনে আসতে বলেছিলেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অভিযোগকারী আসমা বেগম, ইঞ্জিরা বেগম, রাবিয়া বেগম, রিজিয়া বেগম, হাবিয়া বেগম, সাহারা বেগম ও মমতাজ বেগমকে ইউএনও তার বাসভবনে ডেকে নেন। সেখানে প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে অভিযোগকারীদের সাথে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে বিষয়টি গোপন রাখার শর্তে অভিযোগকারী ৭জনের মধ্যে ৪ জনকে ৫০ হাজার করে এবং একজনকে ৪০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে সাহারা বেগম ও মমতাজ বেগমের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের পর টাকা ফেরত দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ইউএনও। পরে ফেরত পাওয়া টাকার বান্ডিল সংবাদকর্মীদের দেখান অভিযোগকারী নারীরা।
ভুক্তভোগী নারীরা অভিযোগ করে বলেন, গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের লক্ষীপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছে থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের ঘর দেয়া হয়নি। এই ঘুষের টাকা ফেরত পেতে গত বুধবার সাহারা খাতুন ও মমতাজ বেগম বাদী হয়ে নাটোর আমলি আদালতে মামলা দায়ের করেন। এনিয়ে গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও জেলা প্রশাসকের নজরে আসে। এরই প্রেক্ষিতে বৃহষ্পতিবার অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নূর মোহম্মদ মাসুম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে অভিযোগকারীদের শুনানী গ্রহন করেন। এসময় অভিযুক্ত আওয়ামীলীগ নেতা নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন না।
শুনানীতে ইউএনও শ্রাবনী রায় ছাড়াও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান শাকিল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ভুক্তভোগীদের শুনানী গ্রহনের একদিন পরই শুক্রবার ইউএনও শ্রাবনী রায় ঘুষের টাকা ফেরত দিয়েছেন অভিযোগকারী নারীদের।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ সূত্রে জানাযায়, উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের লক্ষীপুর গ্রামে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৯টি ঘর ভূমিহীন ও গৃহহীন নারীদের মাঝে হস্তান্তর করে উপজেলা প্রশাসন। সেই আশ্রয়ণে ঠাই হয়, আসমা, রাবিয়া, রিজিয়া, হাবিয়া, সাহারা ও বিউটির। তাদের মধ্যে কেউ বিধবা, কেউ স্বামী পরিত্যাক্তা। দিনমজুরী করে বর্তমানে তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন। গত দুই মাস যাবৎ আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরে বসবাস করছেন তারা। আনুমানিক ৬ মাস পূর্বে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর প্রদান করার কথা বলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম ঘর প্রতি ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রায় ৫ লাখ টাকার জায়গা জমিসহ ঘর পাবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৬ জন নারীর কাছ থেকে টাকা নেন তিনি। এছাড়াও ইঞ্জিরা নামের আরো এক নারীর কাছ থেকে ঘর দেওয়ার কথা বলে ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিলেও তাকে ঘর দিতে পারেননি তিনি। হতদরিদ্র এই নারীরা পেশায় শ্রমজীবি। অন্যের বাড়িতে কাজ করে নিজেদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। ঘর বাবদ প্রদান করা টাকা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ করে দিয়েছেন তারা। সেই টাকার কিস্তি প্রতি সপ্তাহে শ্রম বিক্রি করেই পরিষোধ করতে হচ্ছে।
বিধবা হাবিয়া বেগম জানান,‘৬ মাস আগে আমাকে নজরুল এসে বললো ৫ লাখ টাকার সম্পদ পাবে ঘর নিলে। যদি নিতে চাও তাহলে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। আমি অনেক কষ্ট করে স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ৫০ হাজার টাকা লোন তুলেছিলাম ঘর নেওয়ার জন্য। তখন তেমন কাজকর্ম না থাকার কারনে ওই টাকা থেকে ৫০০ টাকা খরচ করে বাজার করেছিলাম। ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা নজরুলকে দেওয়ার পর বাকি ৫০০ টাকাও চেয়ে বসে। বলে যে, ওই ৫০০ টাকাই আগে দিতে হবে। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কর্জ করে বাকি ৫০০ টাকাসহ মোট ৫০ হাজার টাকা তাকে প্রদান করি। হঠাৎ করেই কয়েকদিন আগে জানতে পারলাম আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর নিতে কোন টাকা লাগেনা। তাই ঋণ করে দেওয়া টাকাটা নজরুলের কাছে ফেরৎ চাই। কিন্তু সে বিভিন্ন তালবাহানা করতে থাকে। টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি।
ভুক্তভোগী ওই নারীরা আরো জানান, বৃহষ্পতিবার শুনানীর গ্রহনের পর বৃহষ্পতিবার রাতে অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম তাঁদের বাড়িবাড়ি গিয়ে নিজের ভূল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করে আসেন এবং তাদের টাকা ইউএনওর মাধ্যমে ফেরত পাবেন বলেও জানিয়েছিলেন।তার কথা ও ইউএনওর ফোনে আশ্বস্ত হয়ে শুক্রবার ইউএনওর বাস ভবনে এসে কথামত ঘুষের টাকা ফেরত পেয়েছেন তারা।
প্রাচীর টপকিয়ে পার হওয়া নারীদের মধ্যে আসমা বেগম সংবাদিকদের জানান, সাংবাদিকদের দৃষ্টি এড়াতে ইউএনওর পরামর্শে তার গাড়ি চালক জয়নাল হোসেনের সহায়তায় টাকাসহ মই বেয়ে প্রাচীর অতিক্রম করেছিলেন।’
এব্যাপারে অভিযুক্ত আওয়ামীলীগ নেতা নজরুল ইসলামের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
অভিযোগকারী নারীদের বাসভবনে ডেকে ঘুষের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে জানতে ইউএনও শ্রাবণী রায়ের সাথে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একাধিকার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার বাসভবনে গেলেও সংবাদকর্মীদের সাথে কথা বলতে রাজী হয়নি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নুর মোহম্মদ মসুমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এব্যাপারে কিছুই জানেননা বলে জানিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। যেহেতু তিনি শুনানী করেছেন বিধায় কাগজপত্র পর্যালোচনা করছেন বলে জানান।
জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুঞার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জুম মিটিংয়ে থাকায় অনেকের মোবাইল ফোন রিসিভ করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ভুক্তভোগী নারীরা অভিযোগের পাশাপাশি ইউএনওর কাছে টাকাগুলি উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। ঘটনা কি হয়েছে জেনে জানাবেন বলে জানান তিনি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *