বামিহাল গ্রামে শান্তি ফিরবে কবে? মামলা করেও থামছেনা হত্যাকান্ড!

নাটোর অফিস ॥
মা চম্পা বেগম হত্যার প্রায় ২০ বছরের মাথায় ছেলে আফতাব খন্দকার প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হলেন। সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে চিহ্নিত নাটোরের সিংড়া উপজেলার প্রত্যন্ত সুকাশ ইউনিয়নের বামিহাল গ্রামে ২০০৩ সালে আফতাব খন্দকারের মা চম্পা বেগম ও শাজাহান আলী নামে অপর একজনকে হত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় খুনের রাজনীতি। স্থানীয়দের দেয়া মতে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এলাকার আধিপত্য বিস্তারে গড়ে ওঠে একাধিক গ্রুপ। চলনবিলের সর্বহারা অধ্যুষিত সুকাশ ইউনিয়নের বামিহাল গ্রামে ওই সময়ের ক্ষমতাসিন দল বিএনপির ছত্রছায়ায় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস ও বিএনপি কর্মী আফজালের নেতৃত্বে দু’টি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে ওঠে এলাকার আধিপত্য বিস্তারে। শুরু হয় একে অপরের ওপর হামলার ঘটনা। ক্ষমতার হাত বদলের সাথে সাথে তারাও দল পরিবর্তন করে। এদের মধ্যেকার হানাহানি ও খুনের ঘটনায় মামলা হলেও রাজনৈতিক দলের চাপে বিচারের মাঝপথে মামলা প্রত্যার করে নিতে বাধ্য হন মামলার বাদি। সম্প্রতি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতায় উভয় গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা বৈঠকের পর আবারো জোড়া খুন ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। শংকিত হয়ে পড়েছেন এলাকার সাধারন মানুষ।

আওয়ামীলীগ নেতা নিহত আফজাল খন্দকারের স্ত্রী তহুরা বেগম বলেন, বধু হয়ে এই গ্রামে এসে শাশুরী চাম্পা বেগমকে হারিয়েছি। প্রতিপক্ষরা তাকে খুন করে। ওই সময়ে খুন তার স্বামীর সমর্থক প্রতিবেশী শাজাহান আলী। প্রায় ২০ বছর পর একই ভাবে তার স্বামীকে হারাতে হলো। এভাবে অনেকেই খুন হয়েছেন। প্রতিপক্ষের হামলায়। প্রতিবাদ করায় হাত-পা কেটে নেয়া হয়েছে প্রতিপক্ষের। এদের বিচার হয়না বলেই এরা বেপরোয়া ও দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক নেতারা এদের মদদ দেয়। আর কতদিন এভাবে খুনের ঘটনা ঘটবে। কে বলবেন বামিহাল গ্রামে শান্তি ফিরবে কবে?।
নাটোরের সিংড়ার বামিহাল গ্রামে অর্ন্তদলীয় কোন্দল ও এলাকার আধিপত্য নিয়ে আওয়ামীলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর গ্রামটি পুরুষ শুন্য হয়ে পড়েছে। এই ঘটনায় পাল্টা পাল্টি মামলা হওয়ার পর পুলিশ দুই গ্রুপের ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদিকে নিহত আওয়ামীলীগ নেতা আফতাব খন্দকার ও আওয়ামীলীগ কর্মী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রুহুল আমিনের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ওউ দুই পরিবারই হত্যাকরীদের ফাঁসির দাবি করেছে। একই সাথে যাদের ইশারায় বার বার এই হত্যার ঘটনা সংঘঠিত হচ্ছে তাদের ক্রশ ফায়ারের আওতায় আনার দাবি জানান তারা। বামিহাল গ্রামের গৃহবধু আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন ,তার পরিবারের তিনজন পুরুষ সদস্য সহ সদস্য সংখ্রা ১৫ জন। রোববারের ঘটনার পর থেকে পুরুষ সদস্যরা বাড়ি ছাড়া। এর মধ্যে একজন রাজশাহী কলেজে পড়ে। অন্যজন স্কুলে পড়ে। আর যে মানুষটির আয়ে সংসার চলে তিনিও ভয়ে বাড়ি ছাড়া। আমরা মেয়েরা আতংকে দিন কাটাচ্ছি। এলাকার খুনের ঘটনা মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার পায়না। রাজনৈতিক নেতাদের চাপে সমঝোতা করে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করা হয়।

মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন বামিহাল গ্রামে গেলে দেখা যায় পরিবেশ শুন সান। পুরুষ মানুষের দেখা মেলে কম। এলাকার গৃহবধুরা নিজেদের মত কাজে ব্যস্ত। নিহত আফতাব খন্দকার ও রুহলের বাড়ির খোঁজ জানতে চাইলে অনেকেই না শোনার ভান করে চলে যান। এসময় বৃষ্টি বাগড়া দেয়। এসময় আশ্রয় নিতে হতে হয় একটি চায়ের দোকানে। সেখানে ক’জন বৃদ্ধ বয়সী সাধারন কৃষক বসে বসে বিড়ি টানছিলেন। পরিচয় দিয়ে তাদের কিছু জিজ্ঞাসা করতেই তারা আস্বীকৃতি জানান কোন কিছু বলতে। মুষল ধারে বৃষ্টি হয় প্রায় দু’ঘন্টা ধরে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর পরই এলাকার পরিবেশ আরো জনশুন্য হয়ে পড়ে। দোকানে বসে থাকা সাধারন কৃষকরা ছুটে যান জমির ধান দেখতে। তীব্র বেগে বৃষ্টি হওয়ায় তারা ধান গাছ পড়ে যাওয়ার শংকা প্রকাশ করছিলেন। তাই জমির ধানগাছ দেতে ছুটে যান জমিতে। তাই প্রায় বাধ্য হয়ে এক সময়ের নেতা নিহত আফজালের বাড়ি খুজে পেলে আফজালের পরিবারের দেয়া ঠিকানা ধরে নিহত আফতাবের বাড়ি খুজে পাই। এর আগে কথা হয় আফজালের পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে। পুরুষ সদস্য ৩ জনের একজনও নেই এলাকায়। নারী সদস্যরা সকলেই আতংকে রয়েছেন। বাড়ির পাশেই প্রতিপক্ষ কুদ্দুস ও ফরিদের বাড়ি। তদের বাড়িতে গিয়ে তালাবদ্ধ দেখা যায়। ওই বাড়ি ভাড়াটে ব্র্যাক অফিসের কাজের মেয়ে বললেন এরা এই বাড়িতে একন থাকেননা। পথে অনেকের সাথেই দেখা হয় কিন্ত কেউ কথা বলতে রাজি হননি। বৃদ্ধ বয়সী দুই একজনের সাথে দেখা হলেও তারা নাম বলতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের কয়েকজন জানান,বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত ঘটনার বিচার না হওয়ায় গত দেড় যুগ ধরে এমন হত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। তাদের অভিযোগ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিচারের মাঝপথে মামলাগুলো সমঝোতার মাধ্যমে প্রত্যাহার করে নেয়ায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা থামছেনা। বেপরোয়া হয়ে উঠছে এসব ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টরা। ২০০৫ সালে বামিহাল পুলিশ ক্যাম্পে সর্বহারাদের হামলায় তিন আমর্ড পুলিশ নিহত হওয়ার পর পুলিশ ফাঁড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়। এর পর থেকে রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ মদদে গড়ে ওঠা বিভন্ন গ্রুপ আরো শক্তিশালী হয়।
এদিকে পিতা হত্যার মামলা করেও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে নিহত আফতাব খন্দকারের ছেলে আব্দুল ওহাব খন্দকার। আব্দুল ওহাব খন্দকারের অভিযোগ সোমবার রাতে মামলা দায়ের করার পর থেকে অনেকের মুখে শুনতে পাচ্ছেন,এসব মামলার বিচার হবেনা। কিছুদিন যাওয়ার পরই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কারনে মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। ইতিপুর্বে এলাকার আধিপত্য নিয়ে সংঘঠিত সংঘর্ষ ও হত্যাকান্ডের ঘটনার মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন নিহতের পরিবার। অঅব্দুল ওহাব সহ এলাকার নারী -পুরুষদের অনেকেই বলেন, চলতি বছর আগষ্ট মাসে সিংড়া সদরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সুকাশ ইউনিয়নের বামিহাল এলাকার বিরোধ মিমাংশা করার পর এক জোড়া খুনের ঘটনা তাই প্রমান করে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের উপস্থিতিতে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই বৈঠকের কুদ্দুস ও ফরিদ গংরা সুযোগ বুঝে আমার বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ফাঁকা গুলি বর্ষন করে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করে। আমার বাবাকে গাড়িত নিয়ে যেতে বাধা দেওয়ার জন্য তারা ফাঁকা গুলি করে ত্রাস সৃষ্টি করে। পরে তারা রুহুলের বাড়িতে গিয়ে রুহুলকে কুপিয়ে আহত করে। তার মৃত্যুর পর আমাদের দোষারোপ করা হচ্ছে। আমার বাবা হত্যা মামলার সমস্যা সৃষ্টি সহ সমঝোতা করার জন্য তারা রুহুলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। ওহাব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,বাবা হত্যার মামলা করে আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তাই মামলা করে কি বিচার পাব তা বুঝতে পারছি।
নিহত রুহুল আমিনের পরিবারের একই অভিযোগ মামলা করে বিচার পাওয়ার আগেই রাজনৈতিক চাপে সমঝেতা করে নিতে হয়। পরিবারের সদস্য জড়িতদের ফাঁসি চান। ক্রস ফায়ার করে তাদের বিচার করা হোক শোকে মুহ্যমান রুহুলের স্ত্রী বলেন, তার স্বামী ঘরে র মধ্যে শুয়ে ছিলেন।সন্ধ্যার পর আফতাব বাহিনী হঠাৎ করে বাড়ির বাহির থেকে স্বামীর নাম ধরে ডেকে বাহিরে বের হতে বলে। এসময় ঘরের জানালা ভেঙ্গে ফেলে সন্ত্রাসীরা। এছাড়ার বাড়ির টিনের বেড়া কেটে সন্ত্রাসীরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে তার স্বামীর ওপর হামলা করে। এসময় মেয়ে রিয়া তার বাবাকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে তাকেও কুপিয়ে আহত করে। মেয়ের হাত ভেঙ্গে তারা। সন্ত্রাসীরা তার শিশু নাতিকেও তুলে আছার দেয়। গলায় চাকু ধরে শিশুকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আমার সামনে আমার স্বামীকে ঘরের মধ্যে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ফেলে রেখে যায়। রিয়া জানায় সে তার বাবার প্রান ভিক্ষা চায়। কিন্তু তারা উল্টো আমাকেই মেরে ফেলার চেষ্টা করে। আমরা আমার বাপের জানের বদলে জান চাই। যারা জড়িত তাদের আমরা ফাঁসি চাই। ক্রস ফায়ার করে তাদের মৃত্যু দেয়া হােক।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন বলেন, তিনি নৌকা প্রতীক নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। সেই আওয়ামীলীগ করা মানুষকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হওয়া দরকার। এজন্য বাদি পক্ষ যে সহযোগীতা চাইবে তিনি তাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
সিংড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দেয়না আওয়ামীলীগ। যদি কেউ এধরনের কার্যক্রমে জড়িত ,তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ সহ নিহত পরিবারকে আইনগত ব্যবস্থায় সহযোগীতা করা হবে। বামিহাল গ্রামের হানাহানি মামলার প্রত্যাহারে কোন ধরনের সমঝোতা বৈঠকের অভিযোগ সঠিক নয়। মিথ্যা ও বিভান্তিকর তথ্য। তবে এলাকার দু’টি সরকারি পুকুর নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ মিমাংশার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কোন পক্ষই তাদের সিদ্ধান্ত না মানায় সিদ্ধান্ত ছাড়াই সমঝোতা বৈঠক শেষ হয়।
সিংড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিল আকতার বলেন,এই জোড়া খুনের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। নিহত দুই জনের ছেলেরা বাদি হয়ে মামলা করেছেন। মামলায় ৬২ জনকে আসামী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছ্ েএলাকায় শান্তিপুর্ন পরিবেশ বজায় রাখতে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এলাকাটি পুরুষ শুন্য কিনা তা অবগত নই। এছাড়া মামলার বাদি কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তা পুলিশকে অবগত বা কোন অভিযোগ করা হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *