সোয়াইর গ্রামের হাতিশালা!

নবীউর রহমান পিপলু ,নাটোর  ॥
চলনবিলের দুর্গম সোয়াইর গ্রাম। জমিদারদের শাসনামলে এই গ্রামে ছিল একটি হাতিশালা। তবে হাতিশালার জন্য কোন স্থাপনা তৈরি করা ছিলনা। গ্রামের একটি বট গাছের নিচে হাতি বেধে রাখা হতো সে সময়ে। জমিদার ও পাইক পেয়াদারা খাজনা আদায়ে বের হলেই এখানে সেই বটগাছের নিচে হাতি বেধে রেখে কিছু সময় মুক্ত বাতাসে জিরিয়ে নিতেন। সেই বটগাছকেই মানুষ জমিদারের হাতিশালা হিসেবে জানতেন। এখন সেই জমিদারীও নেই ,নেই হাতির বিচরন। কিন্তু কালের সাক্ষী হিসেবে সেই বটগাছ এখনও ঠাঁই দাড়িয়ে রয়েছে। সোয়াইর গ্রামের মানুষদের মুখে মুখে এখনও ঘুরে ফিরে আসে হাতিশালার এই বটগাছের কথা। এই বট গাছের নিচে বিশ্রাম নিতেন এই পথে চলাচলকারী দুর গ্রামের মানুষ। জমিদারদের শাসনামলে কর আদায়ে বের হওয়া জমিদারের পাইক-পেয়াদারা এই বট গাছের ছায়ায় কিছু সময় জিড়িয়ে নিতেন। এই প্রাচীন বট গাছ নিয়েও রয়েছে নানা কল্পকাহিনী। এই হাতিশালা বটগাছের পাশেই রয়েছে হাঁটুভাঙ্গা খেলার মাঠ। এখানে এখন ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয়। বছরে একবার করে বসে গ্রামীণ মেলা। আয়োজন করা হয় তাফসির মাহফিল।
আসলে সোয়াইর গ্রাম একসময় ছিল সিংড়ার চৌগ্রাম জমিদারের শাসনে। চৌগ্রাম থেকে সোয়াইর গ্রামের দুরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। সিংড়া সদর থেকে দুরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। চৌগ্রাম জমিদারের আমল ও পরবর্তী সময়ের নান কীর্তি কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে শোয়াইর গ্রামের এই বটগাছকে ঘিরে। ইতিহাস বিদদের মতে, ১৭২০ সালের দিকে জমিদার রসিক রায়ের হাত ধরে এই জমিদার বংশের গোড়াপত্তন। মূলত এটি নাটোর জমিদার বাড়ির অধীনস্থ একটি জমিদারী স্টেট ছিল। চৌগ্রাম জমিদারী রসিক রায়কে দান করেন নাটোরের জমিদার রামজীবন। রামজীবন ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তিনি রসিক রায়ের দুই ছেলে সন্তান থেকে একজনকে দত্তক নেন। যার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি রসিক রায়কে এই জমিদারী দান করেন। আর এই থেকে এই জমিদারীর পথচলা শুরু হয়। এরপর বংশানুক্রমে একের পর এক জমিদার বংশধররা এই জমিদারী পরিচালনা করতে থাকেন। রসিক রায়ের পর জমিদারী পরিচালনা করেন কৃষ্ণকান্ত রায়, রুদ্রকান্ত রায়, রোহিনীকান্ত রায়, রমণীকান্ত রায় এবং জমিদার বংশের শেষ জমিদার ছিলেন রাজেশকান্ত রায় ও রমেন্দ্র কান্ত রায়। পরবর্তীতে ভারতবর্ষ ভাগ হলে জমিদারের শেষ বংশধররা ভারতে চলে যান।

জনশ্রুতি রয়েছে ,চৌগ্রাম জমিদারদের শাসনামলে জমিদার হাতির পিঠে চড়ে এবং তার পাইক পেয়াদারা ঘোড়ায় চড়ে খাজনা আদায়ের জন্য বের হলে এই সোয়াইর গ্রামে আসতেন। এখানে সেই বটগাছের সাথে হাতি-ঘোড়া বেধে রাখতেন। সেই বট গাছের ছায়ার নিচে জমিদার বসতেন কিছু সময় জিরিয়ে নিতে। জিড়িয়ে নেওয়ার পর আবার রওনা হতেন তারা। তবে বর্ষা মৌসুমে চারিদিকে পানিতে থৈ থৈ করত গোটা এলাকা জুড়ে। এই সময় সেই বটগাছের নিচে হাতি বেধে রেখে নৌকায় যেতেন বিভিন্ন গ্রামে খাজনা আদায়ের জন্য। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও সোয়াইর গ্রামের সেই কয়েকশ’ বছর আগের বটগাছকে এলাকার মানুষ বংশ পরমপরায় জেনে আসছেন জমিদারের ‘হাতিশালা’ হিসেবে। তবে এলাকার শতবর্ষী প্রবীণ ব্যক্তিরাও জানেনা এই বটগাছের প্রকৃত বয়স কত? কেউ বলেন ২শ বছর,আবার কেউ বলেন ৩শ বছর বয়সী এই বটগাছ। তবে অদৃশ্য শক্তির কারনে এই বটগাছের ঝরে পড়া পাতা ও ডালপালা কেউ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করেননা বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেননা। ডালপালাও কাটেননা কেউ। গাছের নিচে ঝড়ে পরা পাতাও কেউ নেননা। এসবের বরখেলাপ করলে সেই ব্যক্তির শারীরিক সমস্যা সহ নানা সমস্যার মুখে পড়েন। এলাকার প্রায় সকলেই সেই অন্ধ বিশ্বাস নিয়েই এই বটগাছের দেখভাল করেন। সনাতন ধর্মের মানুষ এখানে এসে মানত করে ভোগ(প্রসাদ) বিতরন করেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বছরের একটি দিন তাফছির মাহফিলের আয়োজন করে থাকেন। এসময় এই বট গাছের চারিদিকে বসে গ্রামীণ মেলা। সবচেয়ে বড় কথা এই বটগাছ দীর্ঘকাল ধরে এলাকার মানুষ সহ পথচারিদের ছায়া দিয়ে চলেছে। মুক্ত বাতাস সহ পথচারীদের প্রশান্তির জায়গা এই বটগাছ। গ্রামের অনেকেই এখনও এই ‘হাতিশালার’ গাছের ছায়ায় বসে প্রশান্তির দিন কাটান। অনেকেই গরম মৌসুমে এই বটগাছের নিচে শুয়ে মুক্ত বাতাসে রাত কাটিয়ে দেন। বোরো মৌসুমে ধান কাটা শ্রমিকরা প্রশান্তির জন্য এই বটগাছের নিচেই আশ্রয় নেয়।তবে গাছের পাশ দিয়ে রাস্তার অস্তিত্ব এখন প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। এক সময়ের ফাঁকা-ধুধু এলাকায় এখন বাড়ি ঘর করে মানুষ বসবাস করছে।
গৃহবধু মেরিনা ফাতেমাও আছিয়া বেগম বলেন, তারা এই গ্রামের বধু হিসেবে আসার পর থেকে শুনে আসছেন এই হাতিশালার কথা। ছায়া দেয় বলে এই গাছের নিচে মানুষ এসে বসে আরাম করে।
এলাকার বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী আলতাফ হোসেন বলেন, তার বাপ-দাদারাও এই গাছের বয়স কত বলতে পারেননি। গাছটিকে আমরা হাতিশালা বলেই জানি।
স্থানীয় বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক আমিনুল হক দুলাল ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তপন সরকার বলেন,চৌগ্রাম জমিদারের সময়ে জমিদাররা কর আদায়ের জন্য সৈয়দপুর যাওয়ার পথে এইখানে হাতি নিয়ে আসতেন। এই বট গাছের সাথে হাতি বেধে রেখে এই গাছের ছায়ায় কিছু সময় অবস্থান করতেন। তাই এই বটগাছকে এলাকার সকলেই হাতিশালা বলে জানেন। তবে গাছের যে অদৃশ্য শক্তি রয়েছে সেটার পক্ষেও যুক্তি উথ¥াপন করে বলেন,কুসংস্কার হলেও গাছটি যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাছ খেকোদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে।
নাটোর এনএস সরকারী কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর অশোক কুমার পাল বলেন,বট গাছের এসব অলৌকিক বা অদৃশ্য শক্তির কোন ভিত্তি নেই। তবে বহুকাল থেকে গাছ রক্ষার জন্য প্রবীণদের উক্তিকে প্রাধান্য দেওয়ায় অন্ধ বিশ্বাস জন্মেছে। বংশানুক্রমে পরিবার ও সমাজ থেকে পাওয়া এসব কুসংস্কারে অনেকেই বিশ্বাস করেন। তবে এই কুসংস্কারে একটা ভাল দিক হলো বিরল প্রজাতি এবং বড় বড় গাছ রক্ষা পাচ্ছে। এক সময় এমন অন্ধ বিশ্বাস আর থাকবেনা।
চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়া উপজেলার দুর্গম সোয়াইর গ্রাম। একসময় এই গ্রামে যাতায়াত করতে অসহনীয় দুভোগ পোহাতে হয়েছে। বর্ষায় এই গ্রামে সহজ যোগাযোগ ছিল নৌ পথ। বহুকাল আগে বর্ষায় চলনবিলের এসব দুর্গম এলাকায় নৌকার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে তৈরি মাটির চাড়ি ও তাল গাছের কান্ডের তৈরি নৌযান ছিল চলাচলের বাহন। ক‘বছর আগেও মানুষ এসব যানে করে চলাচল করেছে। শুস্ক মৌসুমে এই অঞ্চলের মানুষদের কাদা মাড়িয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে হয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্ততে সেই দৃশ্য এখন চোখে পড়েনা। সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় যন্ত্র চালিত যানবাহনে করে এখন এই দুর্গম গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানো যায়। জমিদারদের ‘হাতিশালা’খ্যাত সোয়াইর গ্রামের বটগাছটি রক্ষনা-বেক্ষনের দাবী এলাকাবাসীর।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *