আমাদের শংকর কাকা

                     নবীউর রহমান পিপলু :
আজ ১৩ সেপ্টেম্বর। ১৯৯৫ সালের এই দিন নাটোরবাসী তাদের প্রিয় মানুষ অবিসংবাদিত নেতা বাবু শংকর গোবিন্দ চৌধুরীকে হারায়। তাই  প্রতিবছর দিনটি ফিরে এলেই মনে পড়ে শংকর কাকার কথা। মনের আয়নায় ভেসে ওঠে সেই মানুষটির চেনামুখ।  ভেসে বেড়াতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক  ও আওয়ামীলীগ নেতা শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ছিলেন নাটোরের সব ধর্মের মানুষের প্রিয়জন। অন্যের দুঃখে তিনি হতেন ব্যথিত। বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে ছুটে যেতেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কাছেও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গণে এনে দেয় শূন্যতা। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সকল ধর্ম বর্ণ ও গোত্রের মানুষ জয়বাংলা বলে পাকিস্তানি হায়নাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ নিয়ে রাজ পথে নেমে আসে। তাদের হাতে অস্ত্র বলতে বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, তরোয়াল, বর্ল¬ম আর গাদা বন্দুক। যুদ্ধ কাকে বলে আমিও জানি না। ইট হাতে নিয়ে ওদের পিছু নিয়ে ছুটতে থাকি পাকিস্তানিদের ধরে খতম করার তাগিদে। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় অংশ নিতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বাবা-মা কেউ বাধা দেননি। উপরন্ত সাহস যুগিয়েছেন। বলেছেন যা, দেখ গিয়ে তোর শংকর কাকারাও আছেন সেখানে। একই পাড়ায় থাকি। তাই প্রতিদিনই দেখা হয় শংকর কাকার সঙ্গে। কৈশর বয়সে অসহযোগ আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে সাহস বেড়ে যায় অনেক। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণের পর নাটোর সহ উত্তাল হয় তৎকালীন গোটা পূর্ব পাকিস্তান। শংকর কাকার পদচারণা যেখানে সেখানেই ছুটে যাই তার নির্দেশ বা বক্তব্য শোনার জন্য।  তখন শংকর কাকার বাড়ির কাছে ছিল মুহাকুমা তথ্য অফিস। বাড়ি থেবে বরে হয়ে তথ্য অফিসের বারান্দায় চুপটি করে বসে থাকতাম কাকার অপেক্ষায়। কখন তিনি যুদ্ধে যাবেন ওই অপেক্ষোয়। কিন্তু সঙ্গীদের সঙ্গে মারবেল খেলায় মত্ত হয়ে পড়ায় বাড়ি থেকে কাকার চলে যাওয়া জানতে পারতাম না। এরই মধ্যে  শুরু হয় যুদ্ধ। খবর আসে লালপুরের দুর্গম ময়না গ্রামে পাকসেনারা অবস্থান নিয়েছে। শংকর কাকার বাড়ির সামনে জটলা দেখে সেখানে যাই। কাকা স্থানীয় তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতাদের নির্দেশ দিচ্ছেন কখন কিভাবে লালপুরের ময়না গ্রামে যেতে হবে। ওই নির্দেশনার পর সবাই প্রস্তুতি নিতে থাকে। এরই মাঝে নাটোর ট্রেজারি ভেঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র বিতরণ করা হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার সদস্য সহ যুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী পুলিশ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের। কয়েকটি ট্রাকে করে আমরা রওনা হই ময়না গ্রামের দিকে। দু’দিন অসম যুদ্ধের পর পাকসেনারা পালানোর চেষ্টা করে। ক’জন ধরা পড়লে গণপিটুনীতে মারা পড়ে তারা। ইত্যবসরে শহরের তৎকালীন মিনার সিনেমা হলের (বর্তমানের ছায়াবানী সিনেমা হল) সামনে জনতা স্টোরের বড় বড় তেলের ড্রাম দিয়ে বেড়িকেড তৈরি করা হয়। রাত্রিতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জনতা স্টোরের ছাদে উঠে পাহারা দেওয়া হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই বেড়িকেড দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বন্ধু মহলে হাস্য রসের সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানি বা যে কোন সেনা বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে কারো কোন ধারণা ছিলনা বলেই এই হাস্যরসের কারণ হয়। একটি সুশিক্ষিত বা প্রশিক্ষিত বাহিনীর কাছে ওই বেড়িকেড যে পাটকাঠির বেড়ার মত শক্ত তা বুঝতে পেরেছিলাম ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময়। তুড়ি মেরে সেদিনের বেড়িকেড যে নিমিষেই তছনছ করে দেওয়ার ক্ষমতা সেনা সদস্যদের ছিল সেটা সেময় জানা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তৎকালীন এমসিএ শংকর কাকার সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শে নাটোর শহরকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। তবে ওই সময় শংকর কাকার পাশে থেকে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্র লীগ নেতৃবৃন্দ নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। এদের মধ্যে শহীদ হয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা মজিবর রহমান রেজা, গোলাম রব্বানী রঞ্জু, মরহুম সিরাজ ও রমজান চাচা ছিলেন। নেতৃত্বদানকারীদের অনেকেই এখনও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে লড়াই করে চলেছেন।
নাটোরে ১৩ এপ্রিল সকাল থেকে পরিবেশ থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। নেতৃবৃন্দের অনেকের খোঁজ মিলছিল না। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে আমার বাবা একটি টমটম ভাড়া করে বাসায় আসেন এবং সবাইকে উঠতে বলেন। হাতের কাছে যা পাওয়া গেছে দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে বাবা-মার সঙ্গে টমটমে উঠে পড়লাম। গন্তব্য জানা নেই। পথে বাবা বললেন শংকর বাবুরা গত রাতে ইন্ডিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন।  নাটোরে পাকসেনারা আর কিছু সময়ের মধ্যে ঢুকে পড়বে। বাবা এসব কথা বলার সময় শুনতে পেলাম গুলি ও গোলার শব্দ। প্রথমবারের মত ভয় পেলাম এবার। গুটি শুটি বসে থাকলাম । কিন্তু কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইলে বাবাও বললেন আমরাও ভারতে যাচ্ছি। কিভাবে যাব তেমন ধারণা আমার নেই। একসময় সারদা ক্যাডেট স্কুলের পাশে গিয়ে টম টম থেকে নামলাম আমরা। সেখানে আরো অনেককে দেখতে পেলাম। সামনে বিশাল পদ্মা নদী। জীবনের প্রথম দেখা পদ্মা নদীর রূপ। অন্যদের সঙ্গে আমরাও নৌকায় উঠে পাড়ি জামালাম নদীর ওপারে ভারতের উদ্দেশে। ওপারে ধনীরামপুর এলাকায় নেমে একটি বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য অবস্থান নিই। পরে তাদের দেখানো পথ ধরে কিছুদুর হেঁটে গিয়ে পাকা রাস্তায় উঠি।  বহরমপুর যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় থাকি। এক সময় বাস এলো । বাসে উঠে দেখা পেলাম মুক্তিযুদ্ধের তিন সদস্য মজিবর রহমান সেন্টু, কামরুল ইসলাম ও অনাদি বসাককে। বহরমপুর নেমেই দেখা মিলল আমাদের শংকর কাকার সঙ্গে। লংগর খানার খাবার খেয়ে কোথায় গন্তব্য বাবার কাছে জানাতে চাইলাম। ইত্যবসরে শংকর কাকা তার অবস্থান জানাচ্ছিলেন আবার বাবাকে। এগিয়ে এলেন আমার কাছে, বাবার উদ্দেশে বললেন রশীদ ভাই  আপনার ছেলে  যুদ্ধ করলে বলবেন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু নিজের কথায় বলে চলেছি, আমার বাবার কথা কিছুই বলা হয়নি। সব কাহিনী বলতে শুরু করলে বছর লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর আবার অনেক কথা বা ঘটনার কথা মনে নেই। আমার বাবার নাম রশীদুর রহমান। ছোট্ট সরকারী চাকরী করতেন। স্বাধীনতার লড়াইয়ে তিনিও একজন সক্রিয় সৈনিক। বিদায় নিয়ে বাবা আমাদের নিয়ে তার শৈশব কেটেছে যেখানে সেখানে নিয়ে গেলেন। ক’দিন সেখানে থাকার পর আমি চলে গেলাম পশ্চিম দিনাজপুরে অধ্যাপক আবু সাইদের কুরমাইল প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। বিভিন্নস্থানে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার গল্প বরতে আর ভালো লাগছে না। তবে প্রশিক্ষণকালীন সময়ে শেষ দেখা হয় নাটোরে বীর সৈনিক শহীদ সেলিম চৌধুরীর সঙ্গে। যেদিন আমরা নকশালবাড়ির পানিঘাটা  এলাকায় প্রশিক্ষণের জন্য যাচ্ছিলাম ওই দিন রাতে সেলিম চৌধুরীরা প্রশিক্ষণ শেষে কুরমাইল ক্যাম্পে ফিরে আসে। এছাড়া প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকালীন সময়ে যে মানুষটির সঙ্গে বিভিন্ন ক্যাম্পে একাধিকবার দেখা হয়ে সেই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি আমাদের শংকর কাকা। তিনি ছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে ৭ নং সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। আর আমরাও ওই সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। তাই বার বার দেখা হয়েছে। দেখা হলেই তিনি খোঁজ নিয়েছেন কেমন আছিস। কোন কোন এলাকায় যুদ্ধে গিয়েছিলি। কোন অসুবিধা হলে জানাবি। কোম্পানী কমান্ডারের সঙ্গে যুদ্ধ ক্ষেত্র সহ যোদ্ধাদের খোঁজ খবর নেওয়ার সময় আমাকে দেখিয়ে কি যেন বলতেন। দূর তেকে বুঝতে পারতাম না। চলে যাওয়ার সময় কাকার কাছে জানতে চাইতাম, আমার সম্পর্কে কমান্ডারের কাছে কি বললেন কাকা। প্রতি উত্তরে বলতেন তুই আমার ছেলে বলেছি। তবে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আর দেখা হয়নি শংকর কাকার সঙ্গে।
স্বাধীনতার পর রনাঙ্গন থেকে নাটোরে ফিরে আসার বেশ কিছুদিন পর কাকার সঙ্গে তার বাড়ির দোর গোড়ায় দেখা হয়। কুশল বিনিময় ছাড়া আর কিছুই হয়নি।  একসময় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। কাকার প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে যুক্ত হলেও বাড়ি যাওয়ার পথে কাকার সাথে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়েছে। কাকা তার বাড়ির বৈঠক খানায় দলের নেতা কর্মীদের বিদায় করে গভীর রাত অবধি বসে থাকতেন।  বাতি নিভিয়ে চুপ চাপ বসে সময় কাটাতেন একা একা। কখনও কখনও বাচ্চু ঠাকুর কাকা সঙ্গ দিতেন তাকে। কখনও কখনও  আমার  বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়েছে। ঝিঁঝি পোকার ডাকের সঙ্গে ভুল ভাল বাক্য সাজিয়ে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে কাকার বাড়ির সামনে দিয়ে বাড়ি যেতাম। হঠাৎ কাকার ডাক শুনে চমকে উঠতাম। অবশ্য পরে তা গা-সওয়া হয়ে যায়। বুঝতে পেরে ঘরে ঢুকে বলতাম আপনার ভয় করে না গভীর রাতে একা বসে আছেন ঘরের দরজা খুলে। উত্তরে বলতেন তুই আমার প্রতিপক্ষ, মারলে তুই মারবি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি কেউ আমাকে মেরে ফেলবে না। আমাকে মারতে যেই আসবে, সে বিবেকের দংশনে যন্ত্রণা ভোগ করবে। আমি ঘরে ঢুকলেই কাকীমাকে ডেকে বলতেন, মিষ্টি আর সিঙ্গারা নিয়ে আস। আমার কোন মানা তিনি শুনতেন না। খাওয়া শেষে বলতেন, মিষ্টির সঙ্গে তোকে লবণ খাওয়ালাম। তুই কখনও নিমক হারামী করতে পারবি না। আমি জানতে চাইতাম, লবণ কোথায় খেলাম। বলতেন সিঙ্গারায় লবণ আছে। জীবদ্দশায় আমাদের সঙ্গে তার রাজনৈতিক বিরোধ হয়েছে। মাঝে মধ্যেই এত রাগ হতো কিছু উল্টাপাল্টা খিস্তি করার জন্য গিয়েছি। কিন্তু কাছে যাওয়ার পর সেই ক্রোধ যেন কোথায় হারিয়ে যেত। তার ডাক ও কথা শুনে শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যেত। আমার দুঃখ এত গভীর থাকার পরও তার সঙ্গে রাজনীতি করতে পারিনি। যতদিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, ততদিনই কাকার বিরোধীতা করেছি। কিন্তু শ্রদ্ধাবোধ কমেনি কখনও। তার ভিতরে এমন এক ঐশ্বরিক আকর্ষণ ছিল যে আক্রোশ নিয়ে কাছে গেলেই তাকে আপন মনে হয়েছে। তার কথা বার্তা শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক  ও আওয়ামীলীগের এই প্রয়াত নেতা শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ছিলেন নাটোরের সব ধর্মের মানুষের প্রিয়জন। অন্যের দুঃখে তিনি হতেন ব্যথিত। বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে ছুটে যেতেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কাছেও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গণে এনে দেয় শূন্যতা। যে শূন্যতা এখনও বিরাজ করছে। প্রয়াত এই নেতার প্রতি ছিল সর্ব ধর্ম ও বর্ণের অগাধ বিশ্বাস, আস্থা ও ভালবাসা। যে কোন কাজেই সবাই ছুটে আসতেন এই নেতার কাছে। বিফল হননি কেউ । কোন না কোনভাবে হয়েছেন উপকৃত। তাই তার প্রতি নাটোরের সাধারণ মানুষের সেই ভালবাসার প্রতিফলন হয়েছে এবার। তারা প্রতিদান দিতেও ভোলেনি। প্রয়াত এই নেতার কন্যা উমা চৌধুরী জলিকে এবার  নাটোর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত করে সেই প্রতিদান দিয়েছে। উমা চৌধুরী জলির মাধ্যমে  প্রয়াত এই নেতার ভালবাসা খুঁজে পেয়েছেন অনেকেই। তার শূন্যতা হয়তো পূরণ হবে না। প্রয়াত এই নেতা আমাদের প্রিয় কাকা শংকর গোবিন্দ চৌধুরী যুগ যুগ ধরে নাটোরের মানুষদের কাছে অমর হয়ে থাকবে। (সংকলিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *