নাটোরে চামড়া বিক্রি নেই, পাচার ও পচনের শঙ্কা!

নবীউর রহমান পিপলু ও নাইমুর রহমান, চকবৈদ্যনাথ ঘুরে
মন্দার বাজার চাঙ্গা হবে ঈদের পর- এমনটি ভেবে ঈদের দিনই চামড়া কিনেছিলেন শহরের বড়গাছার দুই সহোদর আলী ও আহম্মদ। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দাম বিবেচনা না করে প্রতিযোগিতার জন্য প্রতিটি ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে ৩৫ পিস গরুর চামড়া কেনেন তারা। ঈদের পরদিন বৃহষ্পতিবার শহরের চকবৌদ্যনাথ চামড়ার মোকামে সেগুলো বিক্রি করতে এসে টের পেলেন, এবার লাভের মুখ আর দেখা যাবে না।

এই প্রতিবেদককে ওই সহোদর জানান, এখন তারা চামড়া বেঁচে লাভ করতে চান না। শুধু কেনা দামে বিক্রি হলেই হবে।

আড়ৎদাররা কাঁচা চামড়া কিনতে সতর্ক হবার আহ্বান জানালেও তাতে কর্ণপাত করেননি মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। তাই বরাবরের মতো এবারও বেশী দামে চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন চামড়ার মৌসুমী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এবার আড়তদাররা নির্ধারিত দামের বাইরে চামড়া কিনতে রাজী হচ্ছেন না। আর ক্ষতির আশংকায় বেশি দামে কিনে নির্ধারিত দামে বিক্রি করছেন না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। অবিক্রিত রেখে কাঁচা চামড়া অনেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

মৌসুমী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, বিগত বছরগুলোতেও তারা দরকষাকষির মাধ্যমে বেশী দামে কাঁচা চামড়া কিনেছেন এবং আড়তগুলোতে সন্তোষজনক দামে বিক্রিও করেছেন। কিন্ত এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। সরকার নির্ধারিত দামের বাইরে যাচ্ছেন না কোন আড়তদার। তাই বাধ্য হয়েই ক্ষতি স্বীকার করে তাদের চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। যারা বিক্রি করছেন না, তারা ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

গুরুদাসপুরের মৌসুমী ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, ‘ ৬ পিস গরুর চামড়া কিনেছিলাম ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকায়। বেঁচতে এসে দেখি, ৫০০ টাকার বেশি কেউ দাম দিতে চায় না। ৩টি বেঁচে বহন খরচটি তুললাম। বাকী ৩টি নিয়ে যাচ্ছি।’

ফিরিয়ে নেয়া চামড়া যথাযথভাবে লবন দ্বারা সংরক্ষণ না করলে পচন শুরু হতে পারে জানালে আতিকুল ইসলাম নামে আরেক মৌসুমি ব্যবসায়ী আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘ বেঁচতে না পারায় যদি পঁচেই যায় তো আগেই মাটি খুঁড়ে পুতে রাখবো।’

অপরদিকে নাটোর চামড়া মোকামের আড়তদারদের দাবী, এবার অনেক শীর্ষ ব্যবসায়ীও বকেয়া টাকা পাননি। তাই বাধ্য হয়ে হাত গুটিয়েই তারা বসে আছেন। তবে ব্যবসা চালু রাখার জন্য নতুন পুঁজি খাটিয়ে তারা চামড়া ক্রয় করছেন। পুঁজি কম হওয়ায় বুঝেশুনে এবং নির্ধারিত দরেই তারা চামড়া কিনছেন।

চামড়া ব্যবসায়ী রইস উদ্দীন বলেন,’ বকেয়া টাকা না পাওয়ায় এবার চামড়া কিনতে নতুন করে সামান্য পুঁজি বিনিয়োগ করেছি। তাই টার্গেট পরিমাণ চামড়া ক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না। বেধে দেয়া দামের ভেতরেই থাকতে হচ্ছে।’

এদিকে বিভিন্ন বছরের তুলনায় এবার চামড়ার আমদানীও কম। ঈদের তৃতীয় দিনেও পাশ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে চামড়া আসা শুরু হয়নি যদিও বিগত বছরগুলোতে ঈদের পরদিনই চামড়া মোকামে পা ফেলার জায়গা থাকতো না চামড়ার জন্য। চামড়াগুলো আড়তঘর থেকে রাস্তা পর্যন্তও রাখা হতো।

ঈদ পরবর্তী সময়ে কাঁচা চামড়ার আমদানী হ্রাসের কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী বলেন, ‘ঈদের আগে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী যারা বকেয়া টাকা পেয়েছেন, ট্যানারদের কিছু শর্ত তাদের মানতে হচ্ছে। এই শর্তের অন্যতম হচ্ছে নির্দিষ্ট মাপের চামড়া। অাগের মতো যে কোন আকৃতির চামড়া এখন রপ্তানীযোগ্য নয় বলেই এমন শর্ত। তাছাড়া মূলত অনাদায়ী পাওনাই চামড়া আমদানী হ্রাসের মূল কারন।’

এদিকে আমদানী হ্রাসের কারনে নাটোর মোকামের চামড়া পাচারের আশংকা করছেন ব্যবসায়ীদের অনেকেই। তাদের মতে, ইতোপূর্বে চামড়ার দাম পড়ে গেলেই একটি ফড়িয়া শ্রেণির উদ্ভব হতো যারা লোকসানে পড়া ব্যবসায়ীদের সামান্য লাভে বা ক্রীতমূল্যেই ক্রয় করে এবং সেসব চামড়া সুযোগমতো সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে পাচার করে।

নাটোর মোকাম থেকে চামড়া পাচারের সুযোগ নেই জানিয়ে জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে নাটোরের বাজার ‘আমদানীশূন্য’ কিন্ত বাস্তবে বাজার জমে উঠতে আরো ১০ দিনের মতো সময় লাগবে। বাইরের জেলাগুলো থেকে চামড়া আসা শুরু হয়নি। চামড়া পাচার হলে রাজশাহীসহ সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে হতে পারে।’

সীমান্ত এলাকায় চামড়া পাচার প্রসঙ্গে রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, ‘চামড়া আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ। কোনভাবেই এটি পাচার হতে দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে রাজশাহীর সব কয়টি থানার ওসিদের নিয়ে বৈঠক করে পাচার রোধে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আশা করছি, রাজশাহীর সীমান্ত এলাকা চামড়া পাচারের রুট হবে না।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *